×

  • নিউজ ডেস্ক

    প্রকাশিত : তারিখ - ২০২৫-১২-২১, সময় - ১৪:১৮:০৬
২০২৫ সাল মধ্যপ্রাচ্যের জন্য আরেকটি বড় ধরনের পরিবর্তনের বছর, যেখানে প্রকাশ্য যুদ্ধের চেয়ে ছায়াযুদ্ধ, সরাসরি জোটের চেয়ে কৌশলগত সমঝোতা, আর একক পরাশক্তির আধিপত্যের চেয়ে বহু-মেরুকেন্দ্রিক বাস্তবতা বেশি দৃশ্যমান। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন-মধ্যপ্রাচ্যে কি সত্যিই শক্তির ভারসাম্য বদলাচ্ছে? নাকি পুরোনো শক্তির কাঠামো নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করছে?

চলতি বছর ইরান–ইসরায়েল সম্পর্কের উত্তেজনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সর্বাত্মক যুদ্ধে না জড়ালেও কার্যত যুদ্ধাবস্থার কাছাকাছি অবস্থান করে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। সিরিয়া, লেবানন ও ইরাকে ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ওপর ইসরায়েলের টার্গেটেড হামলা বেড়েছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বা তার কূটনৈতিক স্বার্থের ওপর ইরান-ঘনিষ্ঠ নেটওয়ার্কের ছায়া আরও স্পষ্ট হয়েছে। এই ছায়াযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো-উভয় পক্ষই ‘রেড লাইন’ জানে, কিন্তু কেউই তা প্রকাশ্যে স্বীকার করে না। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি বা সর্বাত্মক যুদ্ধে যেতে চায় না ইরান, কারণ তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মকভাবে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। আবার ইসরায়েলও জানে, ইরানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ মানে বহু ফ্রন্টে সংঘাত ছড়িয়ে পড়া যা লেবানন থেকে ইয়েমেন সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এই নতুন বাস্তবতায় ছায়াযুদ্ধই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র-কম খরচে বেশি চাপ।


সৌদি–ইরান সম্পর্কে নতুন মাত্রা: ২০২৫ সালে সৌদি আরব ও ইরানের সম্পর্ক নতুন এক মাত্রা স্পষ্ট হয়ে উঠে। ‘শত্রু বনাম শত্রু’ নয়,  বরং একে বলা যায় ‘সংযত ও নিয়ন্ত্রিত বৈরিতা’ বা ‘ম্যানেজড রাইভ্যালরি’। চীনের মধ্যস্থতায় শুরু হওয়া সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের প্রক্রিয়া চলতি বছর জোরালো হয়, যদিও পারস্পরিক অবিশ্বাস পুরোপুরি কাটেনি।

ইয়েমেন ইস্যুতে সৌদি আরব স্পষ্টভাবেই সরাসরি যুদ্ধের মতো ধারণা থেকে দূরে থাকতে চায়। ইরানও এই পর্যায়ে সরাসরি উত্তেজনা বাড়াতে অনিচ্ছুক। কারণ-দু’দেশই বুঝেছে, দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা তাদের অর্থনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ সংস্কার এজেন্ডাকে ব্যাহত করছে।
 
এখানে একটি বড় পরিবর্তন হলো, সৌদি পররাষ্ট্রনীতি এখন শুধু ওয়াশিংটন-নির্ভর নয়। চীন, রাশিয়া এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সমান্তরাল সম্পর্ক গড়ে তুলেছে রিয়াদ। এটি মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘ দিনের শক্তির ভারসাম্যে নীরব কিন্তু গভীর পরিবর্তনের ইঙ্গিত।

মার্কিন প্রভাব যেভাবে রূপ বদলাচ্ছে: চলতি বছরে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়েছে। অনেকেই দাবি করছেন, মার্কিন প্রভাব কমছে। বাস্তবতা একটু ভিন্ন-মার্কিন প্রভাব কমছে না, বরং রূপ বদলাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন আর আগের মতো সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপকে সমাধান মনে করছে না। ইরাক, আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় তিক্ত অভিজ্ঞতা ওয়াশিংটনকে সতর্ক করেছে। ফলে তারা এখন বেশি নির্ভর করছে-আঞ্চলিক মিত্র, অস্ত্র বিক্রি ও গোয়েন্দা সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক চাপ ও নিষেধাজ্ঞার ওপর।

কিন্তু এমন অস্পষ্ট ও বিচ্ছিন্নতার কৌশল এই অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্যে যে শূন্যতা তৈরি করেছে, তা পূরণ করছে চীন ও রাশিয়া। বিশেষ করে চীনের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক উপস্থিতি এ বছর মধ্যপ্রাচ্যে আরও প্রবল হয়ে উঠেছে।


সংঘাতের কেন্দ্রে গাজা: ২০২৫ সালে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতময়-চিত্র বোঝার জন্য গাজা যুদ্ধকে আলাদা করার সুযোগ নেই। গাজা কেবল ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাতের মানবিক ট্র্যাজেডি নয়; এটি গোটা অঞ্চলের শক্তির ভারসাম্য বদলের একটি প্রতীকী মঞ্চ। যুদ্ধ চলমান থাকলেও এর রাজনৈতিক অভিঘাত সীমান্ত ছাড়িয়ে গেছে। ইরান, হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠী এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রতিক্রিয়ায় তা স্পষ্ট।

এই যুদ্ধেই সবচেয়ে দৃশ্যমান হয়েছে ছায়াযুদ্ধের বহুমাত্রিক রূপ। ইরান সরাসরি যুদ্ধে না নেমে প্রক্সি শক্তির মাধ্যমে চাপ বাড়িয়েছে, আবার ইসরায়েলও যুদ্ধক্ষেত্র সীমিত রাখার চেষ্টা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র  তার ঘনিষ্ঠমিত্র তেলআবিবকে সামরিক সহায়তা দিলেও যুদ্ধ থামাতে তার কূটনৈতিক চেষ্টা নজরে পড়েছে। একই সঙ্গে আরব রাষ্ট্রগুলো প্রকাশ্য নিন্দা ও নীরব হিসাবের মাঝামাঝি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। ফলে গাজা যুদ্ধ ২০২৫ সালে মধ্যপ্রাচ্যে একক নিয়ন্ত্রণের যুগ শেষ হয়ে বহু-মেরুকেন্দ্রিক বাস্তবতার দিকে যাত্রাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।

নতুন অস্থিরতা: মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির ভারসাম্য বদলাচ্ছে-এ কথা আংশিক সত্য। কিন্তু এটি কোনো স্থিতিশীল নতুন ভারসাম্যের দিকে যাচ্ছে না; বরং একটি অনিশ্চিত, বহু-কেন্দ্রিক অস্থিরতার দিকে এগোচ্ছে।

ইরান আগের চেয়ে আত্মবিশ্বাসী, সৌদি আরব আগের চেয়ে স্বনির্ভর, ইসরায়েল আগের চেয়ে নিরাপত্তা-উদ্বিগ্ন, আর যুক্তরাষ্ট্র আগের চেয়ে হিসেবি। এই চার বাস্তবতার মুখোমুখী অবস্থান ২০২৫ সালের মধ্যপ্রাচ্যকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে।

এ বছরের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বলা যায়-মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ কমছে না, বরং যুদ্ধের রূপ বদলাচ্ছে। আর এই বদলে যাওয়া যুদ্ধের মাঝেই নতুন শক্তির মানচিত্র ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে-যা হয়তো এখনো পরিপূর্ণতা পাবে না, কিন্তু স্পষ্টভাবে বলা চলে তা আগের মতোও থাকবে না।

নিউজটি শেয়ার করুন



এ জাতীয় আরো খবর..
ইউটিউবে আমরা...
ফেসবুকে আমরা...