×

  • নিউজ ডেস্ক

    প্রকাশিত : তারিখ - ২০২৫-০৮-০৩, সময় - ০৯:৪৬:৩৯

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এসসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর এক বছরে বাংলাদেশ যে পথে যাওয়ার কথা সেদিকে যায়নি। তিনি দায় ও ব্যর্থতা মেনে নতুন বাংলাদেশ গড়তে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন।

রোববার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত সমাবেশ থেকে দলীয় ইশতেহার ঘোষণার সময় নাহিদ সবার সহযোগিতা চান।

নাহিদ বলেন, আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে এ শহীদ মিনারেই আমরা শপথ নিয়েছিলাম এ দেশকে স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্ত করব। আপনারা সেই আহ্বানে সাড়া দেওয়ায় আমরা সবাই মিলে ফ্যাসিবাদী শাসনকে পরাজিত করেছি এবং দেশের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব ফিরিয়ে নিয়েছি।

তিনি বলেন, আজ আবারও এ শহীদ মিনার থেকে আমরা আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি- আসুন, আমরা সবাই মিলে আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক গঠনে ঐতিহাসিক ২৪ দফাকে বাস্তবে রূপান্তর করে সব নাগরিকের স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়ি।

এরপর তিনি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ২৪ দফা ইশতেহার ঘোষণা দেন। এসবের মধ্যে রয়েছে-

১। নতুন সংবিধান ও সেকেন্ড রিপাবলিক

২। জুলাই অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি ও বিচার

৩। গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার

৪। ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থা ও আইন সংস্কার

৫। সেবামুখী প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন

৬। জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী

৭। গ্রাম পার্লামেন্ট ও স্থানীয় সরকার

৮। স্বাধীন গণমাধ্যম ও শক্তিশালী নাগরিক সমাজ

৯। সার্বজনীন স্বাস্থ্য

১০। জাতিগঠনে শিক্ষানীতি

১১। গবেষণা, উদ্ভাবন ও তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব

১২। ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতিসত্ত্বার মর্যাদা

১৩। নারীর নিরাপত্তা, অধিকার ও ক্ষমতায়ন

১৪। মানবকেন্দ্রিক ও কল্যাণমুখী অর্থনীতি

১৫। তারুণ্য ও কর্মসংস্থান

১৬। বহুমুখী বাণিজ্য ও শিল্পায়ন নীতি

১৭। টেকসই কৃষি ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব

১৮। শ্রমিক-কৃষকের অধিকার

১৯। জাতীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনা

২০। নগরায়ন, পরিবহণ ও আবাসন পরিকল্পনা

২১। জলবায়ু সহনশীলতা ও নদী-সমুদ্র রক্ষা

২২। প্রবাসী বাংলাদেশির মর্যাদা ও অধিকার

২৩। বাংলাদেশপন্থি পররাষ্ট্রনীতি

২৪। জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশল

২৪ দফা ইশতেহারের বিস্তারিত…

নতুন সংবিধান ও সেকেন্ড রিপাবলিক

উপনিবেশবিরোধী লড়াই, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের আকাঙ্খার ভিত্তিতে আমরা বহু ভাষা ও সংস্কৃতি ও জাতির নতুন বাংলাদেশ তৈরি করব। পুরাতনকে ঝেড়ে ফেলে, আমাদের রাষ্ট্রের নতুন যাত্রায়, আমাদের প্রথম অঙ্গীকারই হচ্ছে গণপরিষদের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান। জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা পূরণে, আমাদের এই নতুন সংবিধান, একনায়কতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিলোপ করে একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জনকল্যাণমুখী সেকেন্ড রিপাবলিক গঠন করবে। আমাদের নতুন রাষ্ট্র ব্যক্তির জীবন, জীবিকা, মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণ করবে। এই নতুন সংবিধান আমাদের রাষ্ট্রের আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার সুনির্দিষ্ট বিভাজন ও ভারসাম্য নিশ্চিত করবে। আমরা জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করব।

জুলাই অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি ও বিচার

এই জনপদের মানুষের উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার লড়াই, এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয়ই আমাদের প্রেরণা। আমরা জুলাইয়ে সংঘটিত গণহত্যা, শাপলা গণহত্যা, বিডিআর হত্যাকাণ্ড, গুম ও বিচারবহির্ভুত হত্যাসহ আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সময়ে সংঘটিত সকল মানবতা বিরোধী অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করব। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করে আজীবন তাদের পাশে দাঁড়াব। জুলাইয়ের জাতীয় ঐক্য ও হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের মহিমাকে ধারণ করার জন্য আমরা জুলাইয়ের স্মৃতি রক্ষা করব এবং সবসময় ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের সহযোদ্ধাদের পাশে থাকব।

গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার

আমরা এমন একটি ইনসাফের রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চাই যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো হবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পক্ষপাতহীন, নৈর্ব্যক্তিক, মানবিক ও গণমূখী। জনসেবাই হবে তাদের মূলমন্ত্র। একই সংগে রাষ্ট্রের সকল সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ জবাবদিহিতা নিশ্চিতকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে, যেন এই প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীন কাজ করে নির্বাহী বিভাগের কতৃত্বপরায়ণ হওয়ার প্রবণতাকে প্রতিহত করতে পারে। আমরা এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যেখানে জনগণ শুধু নির্বাচনের দিন সকল ক্ষমতার উৎস হবেনা, বরং রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে।  আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন আইন ও এর গঠন প্রক্রিয়ার মৌলিক পরিবর্তন সাধন করবো, এবং রাষ্ট্র-কর্তৃক নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহের আইন করার মাধ্যমে নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব হ্রাস করবো এবং সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্ধীতার সুযোগ সৃষ্টি করবো।

ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থা ও আইন সংস্কার

আমাদের রাষ্ট্রে স্বাধীন বিচারবিভাগ ক্ষমতাবানদের পক্ষে অন্ধ অবস্থান নিবে না, বরং মজলুমকে তার প্রাপ্য ন্যায়বিচার বুঝিয়ে দিবে। এছাড়া একটি সত্যিকারের জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে আমরা ঔপনিবেশিক আমলের সকল আইনকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের ভিত্তিতে যুগোপযুগী করবো। মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে এমন কোন আইন তৈরি করা হবে না। আমরা বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয়কে পরিপূর্ণ আর্থিক স্বাধীনতা প্রদানসহ সম্পূর্ণভাবে ক্রিয়াশীল করবো। মামলার জট ও দীর্ঘসূত্রতা কমাতে আমরা বিচারক এবং আদালতের সংখ্যা বাড়াবো। আমরা মামলার নথিপত্রগুলোকে ডিজিটাল করা এবং মামলার অগ্রগতি অনলাইনে ট্র্যাকিং এর ব্যবস্থা করব। আমরা দেওয়ানী দায় (Civil liability)-এর ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির বিষয়ে একটি আইনগত কাঠামো প্রণয়ন করব। মানহানির মামলায় শুধু ভুক্তভোগী ব্যক্তিই আইনগত প্রতিকার চাইতে পারবেন এই বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করবো। আমরা গরিবদের জন্য বিনামূল্যে আইনগত সহায়তার ব্যপ্তি বৃদ্ধি করব। কিশোর সংশোধনী ব্যবস্থার মানবিকীকরণ ও সমাজে পুনর্বাসনের সুব্যবস্থা করব।

সেবামুখী প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন

বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রকে দলীয়করণের মাধ্যমে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে; আমরা প্রশাসনে সকল প্রকার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করব। আমলাতন্ত্রকে সুদক্ষ ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে আমরা উন্নত প্রশিক্ষণ এবং বিভিন্ন খাতের যোগ্য ও বিশেষজ্ঞদের সরকারে অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবো। নিয়োগ, বদলী, পদায়ন ও প্রোমোশনের ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাই হবে একমাত্র মানদণ্ড। সরকারি কর্ম কমিশনের সকল প্রশাসনিক নিয়োগের ক্ষেত্রে সততা, নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে যথাযথ নিয়োগ-কাঠামো তৈরি করব। সরকারি সেবায় কাগজ, সময় এবং সশরীরে উপস্থিতির প্রয়োজন কমিয়ে ডিজিটাল গভার্নেন্স চালুর প্রতি আমরা বিশেষ গুরুত্ব দেব। রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের মচ্ছব, বিচারহীনতা ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করে আমরা যেকোনো দুর্নীতির দ্রুত বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করবো। সরকারের যেকোনো দাপ্তরিক দুর্নীতি প্রকাশ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বিশেষ আইনি সুরক্ষা দিতে আমরা Whistleblower Protection আইন প্রণয়ন করবো এবং এই লক্ষ‍্যে বিদ‍্যমান সকল আইনী কাঠামোর যথাযথ সংস্কার করা হবে। এছাড়া পরিবার ও সমাজে দুর্নীতি-বিরোধী মূল্যবোধ তৈরি ও সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে আমরা শিক্ষা কারিকুলামে আমূল পরিবর্তন আনবো এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ কর্মসূচি চালু করবো।

জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী

আমরা এমন এক বাংলাদেশ গড়তে চাই যেখানে কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে, ওয়ারেন্ট ছাড়া তুলে নিয়ে যেতে না পারে। আমরা ঔপনিবেশিক আমলের ১৮৬১ ও ১৮৯৮ সালের পুলিশ আইন যুগোপযোগী করবো। আমরা গড়ে তুলবো এমন এক কাঠামো, যেখানে পুলিশ হবে মানবাধিকারের রক্ষক, নাগরিকের সেবক। আমরা পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর রাজনৈতিক অপব্যবহার বন্ধে ও তাদের বদলি-পদায়নে স্বচ্ছ ব্যবস্থা চালু করতে একটি স্থায়ী পুলিশ কমিশন গঠন করবো।  যেকোনো গ্রেফতারের ক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট বা সুস্পষ্ট কারণের উল্লেখ থাকতে হবে এবং গ্রেফতারকারী পুলিশের পদবি ও পরিচয় স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। সুস্পষ্ট পেশাগত প্রয়োজন ব্যতীত সকল পুলিশকে দায়িত্বরত অবস্থায় ইউনিফর্ম পরতে হবে। আমরা প্রতিটি দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যকে বডি ক্যামেরার আওতায় আনবো, যাতে প্রতিটি পদক্ষেপের জবাবদিহিতা থাকে। আমরা চালু করবো কমিউনিটি-ভিত্তিক পুলিশিং এবং মানবাধিকার-কেন্দ্রিক প্রশিক্ষণ। সহিংস অপরাধের প্রতি আমাদের থাকবে জিরো টলারেন্স। আমরা র‍্যাব বিলুপ্ত করবো এবং গোয়েন্দা সংস্থাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে ব্যবহার বন্ধ করতে সুস্পষ্ট আইনি কাঠামো তৈরি করব।



নিউজটি শেয়ার করুন



এ জাতীয় আরো খবর..
ইউটিউবে আমরা...
ফেসবুকে আমরা...