যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদ ক্যালিফর্নিয়া শাখার উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালন

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদ ক্যালিফর্নিয়া শাখা একটি মনোজ্ঞ ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ১০ ই জানুয়ারী তারিখে। অনুষ্ঠানটি প্রবাসী সর্বসাধারণের কাছে ব্যাপক ভাবে সমাদৃত হয়েছে। অনুষ্ঠানটিতে এই ঐতিহাসিক দিনের তাৎপর্য তুলে ধরার জন্য আলোচনা সভা, দেশাত্মবোধক গান, কবিতা এবং প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী জনাব এম এ মান্নান। তিনি অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের বিশেষ ভাবে ধন্যবাদ জানান প্রবাসের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য। বঙ্গবন্ধুকে তিঁনি ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে অভিহিত করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার কাজে যে নিরলস প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন তাঁর বিবরণ দান করেন।
অনুষ্ঠানের মূলবক্তা ছিলেন সর্বশ্রদ্ধেও প্রখ্যাত কলামিস্ট জনাব আব্দুল গফ্ফার চৌধুরী। তিঁনি বলেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসে আওয়ামীলীগের মধ্যে তিন ধারায় বিভক্তি ছিল। একটিতে তাজউদ্দীন আহমদের সমর্থক, অন্যটিতে উত্তরবঙ্গের কতিপয় সংসদ সদস্য এবং আরেকটিতে চক্রান্তকারী মুস্তাকের অনুগামীরা। বঙ্গবন্ধু ফিরে না এলে স্বাধীন বাংলায় এই বিভক্তির পরিণতি হতো ভয়াবহ। যুক্তরাজ্যের লর্ড সভার একজন সদস্যের উদ্ধৃতি দিয়ে তিঁনি বলেন, মহাত্মা গান্ধী, লেনিন প্রমুখ শিক্ষাগত যোগ্যতায় বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বড়ো হতে পারেন কিন্তু একটি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সবার উপরে আর তা হচ্ছে অন্যরা তাঁদের নিজেদের দেশের স্বাধীনতা একবার এনেছিলেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু এনেছেন দুবার। প্রথমবার ৭ ই মার্চে তিঁনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন পাকিস্তানিদের কাছ থেকে স্বাধীনতার সংকল্পে এবং দ্বিতীয়বার বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য সরিয়ে। তিঁনি বলেন বঙ্গবন্ধু বার বার বাংলায় ফিরে আসবেন। প্রথমবার এসেছিলেন ১০ ই জানুয়ারীতে কারামুক্ত হয়ে এবং দ্বিতীয়বার ১৯৯৬ তে যখন জননেত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন স্বৈরাচারী সরকার সমূহ বঙ্গবন্ধুকে সরকারিভাবে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার ২১ বছর পর।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবউদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম। এই ধরণের ইতিহাসভিত্তিক শিক্ষামূলক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজনের জন্য তিঁনি আয়োজকদের আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানান। তিঁনি তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সংক্ষিপ্ত একটি বিবরণী দেন এবং মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অফ অনার দেয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন যে অনেক ত্যাগ এবং তিতিক্ষার বিনিময়ে যে অর্জিত স্বাধীনতা তাঁ রক্ষা করার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যার হাতকে শক্তিশালী করতে হবে এবং স্বাধীনতা বিরোধী সকল অপশক্তিকে দেশের মাটি থেকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে এস পি মাহবুব নামে খ্যাত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা খুব কম অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য প্রবাসী বাংলাদেশী কমুনিটির মাঝে ব্যাপক উৎসাহ পরিলিক্ষিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং একুশে পদক প্রাপ্ত লেখক ডঃ নুরুন্নবী তাঁর স্মৃতিচারণ করে বলেন যে তিঁনি ৭ ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত থাকতে পারেননি কিন্তু ১০ই জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুর খুব কাছাকাছি ছিলেন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণের সময়। পরের দিন কাদেরিয়া বাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তিঁনি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যান যেখানে তাঁদের সাথে যুদ্ধাহত বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধা মেজর খালেদ মুশাররফের সাথে সাক্ষাৎ হয়। বঙ্গবন্ধুর ২৪ এ জানুয়ারীতে টাঙ্গাইলে গমন এবং সেখানে বিশ্ব মিডিয়ার সম্মুখে আবেগ আপ্লুত পরিবেশে অস্ত্র সমর্পনের কথা তিঁনি তুলে ধরেন।

পঁচাত্তর পরবর্তীতে ইতিহাস বিকৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা তুলে ধরেন জার্মান আওয়ামী লীগের প্রধান পৃষ্টপোষক এবং সেখানকার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সভাপতি ৭১ এ “অপারেশন জ্যাকপট” খ্যাত দুঃসাহসিক অভিযানের খুলনা অঞ্চলের অধিনায়ক জনাব আমিনুর রহমান খসরু। সেই অভিযানে মংলা বন্দরে তাঁর নেতৃত্বে চারটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয় এবং একই দিনে দেশের বিভিন্ন নৌ এবং সমুন্দ্র বন্দরে ২৭ টি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়। তিঁনি বঙ্গবন্ধু কন্যার সাফল্য গাঁথার নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিয়ে বলেন যে একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা আবারো সন্ত্রাসী আক্রমণ চালাতে পারে বাংলাদেশে। এবং প্রয়োজন হলে আবারো অস্ত্রহাতে এদেরকে প্রতিহত করতে হবে।

লস এঞ্জেলেসে সর্বজনশ্রদ্ধেয় বঙ্গবন্ধু ক্যালিফর্নিয়া শাখার সম্মানিত উপদেষ্টা বীর মুক্তিযুদ্ধা জনাব জাহেদুল মাহমুদ জামি বলেন ৭ ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে যখন বঙ্গবন্ধু বললেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”, তখনই তাঁরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন তিঁনি রেসকোর্স ময়দানে ছিলেন। এরপরে তিঁনি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর নেতৃত্বে তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যান এবং জানান যে তাঁদের মধ্যে কমান্ডার মানিক সহ অনেকেই শহীদ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তখন আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁদের অস্ত্র সমর্পন করে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্য আদেশ দেন।

অনুষ্ঠানে প্রাণবন্ত কবিতার উপস্থাপনা করেন ক্রান্তির জিনাত আরা এমা , জাহিদ হোসেন এবং শীলা মুস্তাফা। প্রবাসী প্রকৌশলী রেজা শামীমের কবিতা “আমাদের যীশু” পাঠ করা হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর লেখা এবং হাসান আরিফের কন্ঠে সদ্য প্রকাশিত অসাধারণ কবিতা বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ছবি সম্বলিত একটি কবিতা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী বৃন্দ লুইপা, পীযুষ ইসলাম এবং দীনাত জাহান মুন্নী সুরেলা কণ্ঠে দেশাত্মবোধক গানের মূর্ছনায় অনুষ্ঠানের আবহ সম্মৃদ্ধ করেন।

অনুষ্ঠানটি প্রাণবন্ত উপস্থাপন করেন লস এঞ্জেলেসের অতিপরিচিত উপস্থাপক রৌশনী আলম। অনুষ্ঠান শুরুতে সাধারণ সম্পাদক রানা হাসান মাহমুদ এই দিনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়ার কথা বলেন। ৮ ই জানুয়ারী থেকে ১০ ই জানুয়ারী পর্যন্ত সারা বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সংবাদ শিরোনাম ছিলো বলে উল্লেখ করেন এবং তাঁর বক্তব্যের সাথে সঙ্গতি রেখে এনবিসি নিউসের একটি ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। লস এঞ্জেলেস কমিউনিটি লিডার এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা মোমিনুল হক বাচ্চু দর্শক শ্রোতাদের স্বাগত জানান। এবং বঙ্গবন্ধু এবং শহীদের স্মৃতি স্মরণ করেন।

সংগঠনের সহ সভাপতি জনাব শওকত আলম বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে গত দুবছরে সংগঠনের কার্যক্রম সংক্ষিপ্ত ভাবে তুলে ধরেন এবং এর পরই কার্যক্রমের উপর একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হয়।

সিনিয়র সহ সভাপতি জনাব শহীদ আলম তাঁর নিজের লেখা একটি গান বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রীধাঞ্জলি হিসাবে গেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সভাপতির ভাষণে পরিষদের সভাপতি জনাব নজরুল আলম বলেন বঙ্গবন্ধুর আগমনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব সুসংহত হয় এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় দ্রুত সদস্য পথ পাওয়ার পথ সুগম হয়।

তিনি আন্তরিক ভাবে সকল সম্মানিত অতিথিবৃন্দ, কলা -কৌশলী এবং সংগঠকদের ধন্যবাদ জানান। অনুষ্ঠানের শেষে আরো একবার সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রযোজিত ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হয়। তাৎক্ষণিক ভাবে দর্শক শ্রোতাদের কাছ থেকে অনুষ্ঠানটি শিক্ষামূলক এবং গুরুত্বপূর্ণবলে সবার কাছে প্রশংসিত হয়।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.