স্বাধীনচেতা শাহজাহানের নার্সারি সাম্রাজ্য

কালীপদ দেবনাথ, কুমিল্লা থেকে

শাহজাহান চতুর্থ শ্রেণি পাস। বয়স সবে আঠারো। অভাব অনটনের সংসার চালাতে ইলেকট্রিক এর কাজ শেখে ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ করতো। প্রতিদিন দুইশো-তিনশো টাকার জন্য সুদুর ঝাঁকুনিপাড়া থেকে সাইকেল চেপে রেইসকোর্স আসতো, সেখানেই তার কর্মস্থল।

শাহজাহানের প্রতিদিনের নিত্তনৈমত্তিক কাজ হলো সকালে ঘুম থেকে উঠেই সাইকেল চেপে শহরে আসা, এবাড়ি ওবাড়ি কিংবা দোকানে বসে কাজ করা। কখনো মালিকের নির্দেশ কখনো বাড়ির নির্দেশ।

নির্দেশ শুনতে শুনতে ত্যক্তবিরক্ত শাহজাহানের আচমকা বোধোদয় হলো স্বাধীন কিছু করবে। কিন্তু স্বাধীন কিছু করবো বললেইতো আর হয়ে যায়না, তার জন্য লাগে পর্যাপ্ত পুঁজি, ইচ্ছাশক্তি আর অধ্যাবসায়।

শাহজাহানের পুঁজি ব্যতীত বাকি দুটোই ছিল। ইচ্চাশক্তি আর অধ্যাবসায় থাকলে পুঁজি অবশ্য এমনিতেই চলে আসে। শাহজাহান ঋণ নিলো, গোমতী নদীর ভূখন্ডে তার চাচার জায়গাটাও পেল।

গোমতীর চরে ১৩ গন্ডা জায়গা বছরব্যাপী ৭,৫০০ টাকায় লাগিত (ইজারা) নিলো। ঋণ নিল ৫০০০০টাকা।

ঋণ পেয়েই নার্সারিতে মনোযোগী হলো, কিনে আনলো ২৫০ টি আপেলকুলের কলমচারা, কুমড়ার ন্যায় একটা শস্য নাম ‘স্কোয়াশ’ বাংলায় যার নাম চুষা।

মোরগঝুটি, গোলাপ, বেলি, সূর্যমুখী, গাদাফুলের নানা শ্রেণি, চামেলী, ডালিয়া, রঙন, মাধবী সহ নানারকম ফুলের হাজার হাজার চারা তৈরি করলো। সবজির চারার মধ্যে ক্যাপ্সিকাম, লেটুসপাতা,কাচামরিচ, লাউকুমড়ার ফলন। ফলের চারা আগামীতে চাষ করবে সেরকমই চিন্তা আছে তার।

এই যে দুইশ পঞ্চাশটি আপেলকুল, তাতে এখন ছোট ছোট আপেলের ন্যায় ফল ধরে। তা দেখে শাহজাহানের চোখেমুখে কি মধুর হাসি ফুঁটেছে!

আপেল কুলের এক একটিগাছ থেকে ১৫-২০ কেজি হিসেবে প্রায় ৩৫০০ কেজি আপেলকুল পাবে সে। বাজারে কেজি দরে ১২০-১৫০ টাকায় বিক্রি করলে বেশরকমের মুনাফা হবে।

স্থানীয়লোক ও গ্রামবাসী ওদেরওতো কিছু দাবী আছে এই বাগানে এটা সে ধরেই নিয়েছে। তাই ওদেরও আধাকেজি কি এককেজি করে সে চাইলেই মাঝেমধ্যে উপহার দিয়ে দেয়।

মাঝেমধ্যেই এলাকার লোকজন না বলেই গাছ থেকে ফল নিয়ে যায়। সেটা কিভাবে আটকানো যায় জানতে চাইলে বের হয়- এ নিয়েও শাহজাহানের চমৎকার পরিকল্পনা আছে।

আগামীবার কলম কেনবার সময় সে বাড়তি কলম কিনবে, সবাইকে একটা করে কলম দিয়ে সবার চাহিদা পূরণ করবে, যতদিন সবার বাড়িতে বড়ই না থাকবে এসব যে ঠেকানো দায়!

শাহজাহানের উত্তর শুনে বিমোহিত হলাম, কত সুন্দর তার পরিকল্পনা!

শাহজাহান এখন পুরোদস্তুর নার্সারী চারা রূপণকারী এবং বাগানী, কর্মক্ষেত্রে সময় না দিলে যে ফলন ভাল আসেনা। একধ্যানে একমনে সে শুধুই বাগান করবে, তাতে তার ফসল ও লাভ দ্বিগুণ হবে। আশেপাশের কিছু জমিও সে ইতিমধ্যে লাগিত নেওয়ার কতাবার্তা চূড়ান্ত করে ফেলেছে, বাগানের পরিধি আরো বড় হবে, আরো লোক নিয়োগ হবে।

শাহজাহানের মা আর ছোটভাই মিলে এসবে সাহায্য করছে। শাহজাহানের ছোটবোন সরকারী মহিলা কলেজে উচ্চমাধ্যমিক প্রথমবর্ষের ছাত্রী। শাহজাহান নিজেই বোনের পড়াশোনার দায়িত্বপালন করছে।

এসব বিষয়ে নার্সারির মালিক শাহজাহান বলেন, “আমি যদি আরো আগে চাকরি ছেড়ে নার্সারিতে সময় বেশি দিতাম, নার্সারির প্রতি যত্মশীল হতাম, তাহলে এখন যে লাভের মুখ দেখছি তার দ্বিগুণ লাভ হতো। পরিশ্রম করলে ফল আসে, বৃথা যায় না।”

শাহজাহানের স্বপ্ন নার্সারির মাধ্যমে নিজের মা, ছোট ভাই এবং বোনের স্বপ্নপূরণ করবে।

শাহজাহান অদম্য যোদ্ধা, যুদ্ধ করেই সে জীবন গড়তে আগ্রহী। পরাধীন নয়, সে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়।

আত্মবিশ্বাসী শাহজাহানের স্বপ্ন পূরণ হোক, সেইপ্রত্যাশা।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.