সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসলামি দাওয়াহ

ড. মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন

বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীতে যত দৃশ্যমান সম্পদ রয়েছে, এর চেয়ে অনেক বেশি সম্পদ অদৃশ্যমান। সময় ও কালের চাহিদা অনুযায়ী এই সম্পদকে আল্লাহ তাআলা দৃশ্যমান করেন এবং মানবকল্যাণে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলেন। এসব দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সম্পদ অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে সেরা নিদর্শন। আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয়ই নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃজনে ও রাত-দিনের পালাক্রমে আগমন ও প্রস্থানে বহু নিদর্শন আছে ঐ সব বুদ্ধিমানের জন্য, যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে (সর্বাবস্থায়) আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে এবং তা লক্ষ করে বলে ওঠে, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এসব উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেননি। আপনি অনর্থক কাজ থেকে পবিত্র (আল ইমরান ১৯০-১৯১)।

বর্তমানে প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবীর অবস্থা তিন দশক আগেও এমন ছিল না। অথচ কম্পিউটারসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি আবিষ্কারের সব মৌল উপদান আমাদের আশপাশেই বিদ্যমান ছিল। সময়, প্রয়োজন ও চাহিদার আলোকে এসব আবিষ্কার দৃশ্যমান হয়েছে। সময় ও যুগের চাহিদায় প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রিক মিডিয়া বিকশিত হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে প্রচলিত তথ্যবিপ্লবের ধারণা সম্পূর্ণ পালটে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষকে একটি যোগাযোগ প্ল্যাটফরমে নিয়ে আসার বিস্ময়কর সময় মানুষ অতিক্রম করছে। শক্তিশালী এই প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে কোনো একটি সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়। আমরা এসব মিডিয়ায় অনেককেই ইসলাম প্রচার করতে দেখি। তবে ইসলাম প্রচারের নামে অনেক অনৈসলামিক কাজে এই মিডিয়ার ব্যবহার বেশি। আবার অনেকে বিকৃতভাবে ইসলামের উপস্থাপনে এসব মিডিয়াকে ব্যবহার করছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। সুতরাং, এসব মিডিয়ার ব্যবহারে হালাল-হারামের সীমারেখা মেনে চলতে হবে। ইসলাম মূলত উন্মুক্ত প্রচারধর্মী জীবনাদর্শ। সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তিশালী এই প্ল্যাটফরমকে ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রচারের শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে একদিক থেকে বিশ্বমানবতা আদর্শবাদী ইসলামের সঠিক চিত্র পাবে, অন্যদিকে ইসলামের নামে চরমপন্থা বা বিকৃত ইসলামের স্বরূপ উন্মোচিত হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার সীমানাহীন প্ল্যাটফরমে চোখের গোনাহসহ নানাবিধ কপটতা থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে ইসলাম প্রচারের গুরুত্ব অনেক বেশি। যেমন—আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি তার রসুলকে হেদায়াত এবং ‘দিনে হক’ দিয়ে পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি এই দিনকে অন্য সব দিনের ওপর বিজয়ী করেন, চাই তা মুশরিকদের কাছে যতই অসহনীয় হোক না কেন।’ (সুরা আস সফ :৯)

কুরআনে বর্ণিত এই আয়াত মানুষকে এই বার্তা দিচ্ছে যে, ইসলামকে অন্য ধর্মের ওপর বিজয়ী করার জন্য হালাল পন্থায় সবকিছু ব্যবহার করা জায়েজ। যদিও বিষয়টি কাফেরদের কাছে অপছন্দ হয়, কিন্তু ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় দিন প্রচার করার ক্ষেত্রে যাদের বিভিন্ন অপরাধ ও গোনাহে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে; তাদের জন্য জায়েজ নয়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিনদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য অনেক পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয় তারা যা করে, আল্লাহ তা অবহিত আছেন।’ (সুরা নুর :৩০)

বর্তমানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসমূহে বিশেষ করে ফেসবুকে দৃষ্টি অবনত রাখা যায় না। এখানে নিজের অজান্তে অনেক সময় ভালোর পরিবর্তে খারাপে জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় কী? এ বিষয়ে রসুল (স.)-এর একটি হাদিসে দৃষ্টি দেওয়া যাক। হজরত জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবি করিম (স.)-এর কাছে আচমকা নজর পড়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করলাম। তিনি আমাকে আদেশ করলেন, যেন আমি আমার দৃষ্টি দ্রুত ফিরিয়ে নিই।’ (সহিহ মুসলিম ) ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো, সোশ্যাল মিডিয়ায় গোনাহে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকলে তার জন্য দিন প্রচার করা জায়েজ নয়। কারণ হাদিসে হজরত রসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘হে আয়েশা! তুমি সামান্য পরিমাণ গোনাহ থেকেও বেঁচে থাকো, নিশ্চয়ই তা আল্লাহ তায়ালা অনুসন্ধান করবেন।’ (ইবনে মাজাহ)

সোশ্যাল মিডিয়ার ভালো দিকগুলো আমাদের আত্মস্থ করতে হবে আর খারাপ দিকগুলো বর্জন করতে হবে। এই মিডিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্তরা চোখের গোনাহ সবচেয়ে বেশি করে থাকেন। নিঃসন্দেহে দুই চোখের ব্যভিচার হলো তাকানো (হারাম দৃষ্টিপাত), দুই কানের ব্যভিচার হলো শোনা (যৌন উদ্দীপক কথা), জিহ্বার ব্যভিচার হলো কথোপকথন করা (অশ্লীল), হাতের ব্যভিচার হলো (অন্যায়ভাবে, অনৈতিকভাবে) শক্ত করে ধরা, পায়ের ব্যভিচার হলো (পাপ কাজের জন্য) হেঁটে যাওয়া, হূদয়ের ব্যভিচার হচ্ছে কামনা-বাসনা করা। আর লজ্জাস্থান তা সত্যায়িত (পাপ কাজ করায়) করে বা মিথ্যা (পাপ থেকে বিরত রাখে) সাব্যস্ত করে।’ (সহিহ মুসলিম) আমার বিশ্বাস, সব খারাপ ও অপসংস্কৃতি পরিত্যাগ করে মুসলিম সমাজ সোশ্যাল মিডিয়াকে সঠিকভাবে ইসলামি দাওয়াহর কাজে ব্যবহার করবে এবং পৃথিবীকে আরো বেশি সুন্দর ও তাওহিদমুখী সমাজ উপহার দেবে।

লেখক: ইনটারফেইথ স্পেশালিস্ট ও অধ্যাপক, দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.