সাক্ষাৎকার: শ্রম অধিকার নিয়ে শঙ্কা নেই

বাংলাদেশের মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার বিষয়ে সম্প্রতি উদ্বেগ জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি অব্যাহত রাখা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এ ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে কথা বলেছেন বিজিএমইএ সভাপতি মো. ফারুক হাসান:

বাংলাদেশের মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এতে ইইউতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি অব্যাহত রাখা নিয়ে কোনো হুমকির আশঙ্কা করছেন কি না?

ফারুক হাসান : বাংলাদেশ গত ১০ বছরে দেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ উন্নতির দিক থেকে ঈর্ষণীয়। বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ রেটপ্রাপ্ত লিড সার্টিফায়েড কারখানার সংখ্যা ২০৪টি। শীর্ষ ১০০টি সর্বোচ্চ মানের লিড সবুজ কারখানার মধ্যে ৫৪টি বাংলাদেশে রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ১০-এর মধ্যে ৯ এবং ২০-এর মধ্যে ১৮টি লিড সনদ পাওয়া কারখানা রয়েছে বাংলাদেশে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক অংশীজনদের নিয়ে দেশের শ্রমখাতের কর্মপরিবেশ ও শ্রম অধিকার বিপুল প্রশংসিত হয়েছে। কাজেই হুমকির আশঙ্কা নেই।

এর পরও দেশের শ্রম অধিকারের মানদণ্ডের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। সম্প্রতি ইইউয়ের প্রতিবেদনে এমনটাই উঠে এসেছে। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?

ফারুক হাসান : প্রতিবেদনে উঠে আসা বিষয়গুলো নিয়ে আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করব। এ বিষয়ে পরে মন্তব্য করা যাবে। তবে গত ১০ বছরে তিনবার শ্রমনীতি সংশোধন হয়েছে। শ্রমবিধি হয়েছে। এ ছাড়া ১৯৮৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরে ১৩৮টি ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে এক শর বেশি ইউনিয়ন নিবন্ধিত হয়েছে। বর্তমানে এক হাজার ২০০-এর বেশি ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে। নিয়মিত শ্রমিক ইউনিয়নের সংখ্যা বাড়ছে। তবে আরো উন্নতি করতে হবে। বাড়াতে হবে অংশীজনদের সক্ষমতা। বিশেষ করে যাঁরা ট্রেড ইউনিয়ন করেন, তাঁদের আরো সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকতে হবে।

প্রতিবেদনে শ্রমিক হয়রানি, ছাঁটাই, মামলা এবং ইউনিয়নবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

ফারুক হাসান : ইউনিয়নের সংখ্যাই বলে দেয় শ্রমিকদের কথা বলার অধিকার ও দর-কষাকষির স্বাধীনতা বেড়েছে। এক হাজার ২০০-এর বেশি ইউনিয়ন রয়েছে। এ ছাড়া শ্রমিক হয়রানি নিয়ে বিতর্ক আছে। আর কোনো কর্মীকে ছাঁটাই করতে হলে শ্রম আইন মেনেই মালিকদের করতে হয়। এ ব্যাপারে বিজিএমইএ সদস্যদের কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়।

দেশের শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও পথ নকশায় কতটা অগ্রগতি হয়েছে এবং ঘাটতি কোথায়?

ফারুক হাসান : আইএলও পথ নকশা অনুসারে প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ। এটা একটা জায়গায় থেমে আছে। সেটা হলো রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড)। আমরাও মনে করি, এক দেশে একই আইন হবে। সেই অনুসারে ইপিজেড এলাকাগুলোতে শ্রমিকদের দর-কষাকষি বা শ্রমিক সংঘ (ট্রেড ইউনিয়ন) করার অধিকার থাকা উচিত। সরকার সেই বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগ নেবে। আমাদের প্রত্যাশা এটাও একটা সময়ের মধ্যে হয়ে যাবে।

তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রম অধিকার ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারের নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

ফারুক হাসান : হ্যাঁ, প্রতিষ্ঠানগুলোর জনবল এবং সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। এসব বিষয়ে জোর দিতে হবে। বিশেষ করে কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও অধিদপ্তরকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। বাড়াতে হবে জনবল। তাদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।

আপনারা বলছেন, শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, অথচ শ্রমিকরা মজুরি নিয়ে আন্দোলন করলে তাদের দমন করা হয়, মামলা দেওয়া হয়?

ফারুক হাসান : আমি মনে করি না কোনো শ্রমিককে দমন-পীড়ন করা হয়। বর্তমানে কারখানার মালিক ও শ্রমিকরা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কারখানায় কাজ করছেন। সম্প্রতি মজুরি আন্দোলনে শ্রমিকরা কারখানা ভাঙচুর করলেও পুলিশ কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। বরং তারা যখন রাস্তায় নামে, তখন পুলিশ তাদের বাধা দেয়।

মজুরি আন্দোলনে চারজন শ্রমিক নিহত হওয়া ও ১৮ হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এ বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?

ফারুক হাসান : নিহত শ্রমিকদের ঘটনার বিষয়টি দুর্ঘটনা। এখানে কোনো মালিক জড়িত নন। একজন শ্রমিক মারা গেছেন আতঙ্কে। তবে মারা যাওয়া সব শ্রমিকের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে বিজিএমইএ। আর যাঁরা কারখানা ভাঙচুর করেছেন মালিকরা সম্পদ রক্ষায় মামলা করেছেন।

শ্রম অধিকার, মানবধিকার ও অতিরিক্ত কাজের নামে জোর করে কাজ চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এ ব্যপারে আপনি কি বলেন?

ফারুক হাসান : এটা ঠিক নয়। বলার জন্য বলা হয়। শ্রমিকরা নিজেরাই অতিরিক্ত কাজ করতে চান। কেননা এর ফলে তাঁরা প্রকৃত মজুরির চেয়ে মাস শেষে অনেক বেশি মজুরি পান। ফলে তাঁদের জীবন-যাপনে আরেকটু বেশি স্বাচ্ছন্দ্য আসে। আর মালিকরা তা নিয়ম মেনেই করেন।

বৈশ্বিক মন্দা কারখানায় কাজ কম। আন্তর্জাতিক চাপ, সব মিলিয়ে রপ্তানিতে কেমন চাপ অনুভব করছেন?

ফারুক হাসান : আমরা আগেই বলেছিলাম, বিশ্বে মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্ববাণিজ্য কিছুটা ধাক্কা খাবে। এর কারণে দেশের রপ্তানি আয়ও কিছুটা কমবে। তবে এটা ঋণাত্মক হবে না। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ শতাংশ। এটা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কমে ৫ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। তবে প্রতিযোগী অন্য দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

ফারুক হাসান : বৈশ্বিক মন্দায় রপ্তানি ঋণাত্মক হলেও অন্য দেশে ক্রয়াদেশ স্থানান্তর হচ্ছে, এমনটা নয়। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতায় কোনো কোনো ক্রেতা ক্রয়াদেশ সাময়িকভাবে স্থগিত করছেন।

নতুন মজুরি ঘোষণার পর পোশাকের দর বাড়ানো নিয়ে ক্রেতাদের কেমন সাড়া পাচ্ছেন?

ফারুক হাসান : ইতিবাচক সাড়া আছে। এরই মধ্যে বিশ্বের বড় ক্রেতা ও ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলো সাড়া দিতে শুরু করেছে। এর মধ্যে এইচ অ্যান্ড এম, অ্যালকট এবং ডেনমার্কের বেস্ট সেলার দাম বাড়ানোর ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিয়েছে।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.