রেশম চাষে স্বাবলম্বী বহু নারী

রাজধানী ঢাকার পাশেই গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার নিভৃত একটি গ্রাম বড়হর। গ্রামটির অধিকাংশ বাসিন্দার পেশা কৃষিকাজ হলেও সিংহভাগ কৃষকের নিজস্ব কোনো জমি না থাকায় অন্যের জমি বর্গা নিয়ে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। এতে সংসারে পুরো বছরই লেগে থাকতো অভাব-অনটন।

কৃষিকাজে জীবনমান উন্নত না হওয়ায় কোনো মতেই ঘুরছিল না তাদের ভাগ্যের চাকা। এমন অবস্থায় কৃষকদের দুর্দশা লাগবে এগিয়ে আসে বাংলাদেশ রেশম বোর্ড। এলাকার নারীদের স্বাবলম্বী করতে তারা রেশম চাষে উদ্বুদ্ধ করেন। সরকারের এমন উদ্যোগে কয়েক বছরেই রেশম চাষ বদলে দিয়েছে গ্রামীণ নারীদের জীবনধারা, আর এই রেশমেই জড়িয়ে গেছে তাদের স্বপ্ন।

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার করিহাতা ইউনিয়নের দিঘিরকান্দা ও রায়েদ ইউনিয়নের বড়হর গ্রামে রেশম চাষ করে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখছে। গ্রাম দুটির বাড়িতে বাড়িতে এখন তৈরি হয়েছে রেশম চাষের পলু ঘর। রেশম চাষের মাধ্যমে দুটো গাঁয়ের নারীদের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা আরো অনেককেই আগ্রহী করে তুলছে এই এলাকায়।

বড়হর গ্রামের জাহেদা আক্তার বলেন, তার স্বামী কৃষিকাজ করেন। সংসারের কাজ শেষে তাকে বাড়িতে অলস সময় কাটাতে হতো। স্বামীর একার সামান্য রোজগারে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ খরচ জোগাতে সমস্যা তৈরি হতো তাদের পরিবারে।

গত পাঁচ বছর আগে তিনি বাড়ির বারান্দায় রেশম চাষ শুরু করেন। এ চাষের মাধ্যমে এখন তো প্রতি বছর তিনি নিজে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা সংসারের জোগান দেন। এতে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখছেন। রেশম চাষ করে সংসারের পুরো খরচ জোগাতে সরকারি সহায়তা বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।

এই গাঁয়েরই বধূ শিল্পী রানী বলেন, তাদের হিন্দুপল্লীতে প্রতিনিয়তই রেশম চাষে ঝুঁকছে নারীরা। সংসারের অলস সময়ে ঘরে বসে একজন নারী হিসেবে বাড়তি আয় করতে পারছেন। আগে নিজের বিভিন্ন খরচের জন্য স্বামীর হাতের দিকে তাকে চেয়ে থাকতে হতো। এখন ঘরে বসেই তিনি আয় করতে পারেন। নিজের ও সন্তানদের খরচ মিটিয়ে স্বামীর হাতেও টাকা তুলে দিতে পারেন তিনি। এভাবে স্বাবলম্বী হওয়াটা তাকে অন্যরকম আনন্দ দেয়।

দিঘিরকান্দা গ্রামের কামাল হোসেন বলেন, কিছুদিন আগেও অভাবের সংসার ছিল তার। অভাব মোচনে তার স্ত্রী রেশম চাষ শুরু করেন। তিনি মাঠে কাজ করেন আর তার স্ত্রী বাড়িতে রেশম ও গবাদিপশু পালন করেন। এতে কয়েক বছরেই তার সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।

আঞ্চলিক রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্র গাজীপুরের অধীন গাজীপুরের কাপাসিয়া, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় রেশম চাষ হচ্ছে। তাদের দেয়া তথ্য মতে, গাজীপুরের কাপাসিয়ায় হতদরিদ্র পরিবারের নারীদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে এ চাষ শুরু করা হয় বেশ কয়েক বছর আগে।

সমন্বিত প্রকল্পের অধীন রেশম চাষে নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তাদের এই চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে দুটি গ্রামের ৩০ জন নারীর বাড়িতে পলু ঘর নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক বিতরণ করা হয়েছে। রেশম পোকার খাবারের জন্য স্থানীয় সরকারি বরদার খালের উভয় পাশে ৫ কিলোমিটার এলাকায় তুঁত গাছ রোপণ করা হয়েছে। লাভজনক এই রেশম চাষে এলাকার বহু নারী স্বাবলম্বী হওয়ায় অনেকেই এ চাষে যোগ হচ্ছে। এই এলাকায় দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে রেশম চাষ।

সরকারি এ কর্মসূচির বাইরেও গ্রামের শতাধিক পরিবারের নারীরা রেশম চাষে নিজেদের পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন। তাদের সহায়তায় রেশম বোর্ড থেকে চলতি বছর বাড়ি বাড়ি রোপণের জন্য তুঁত গাছের দেড় হাজার চারা বিতরণ করা হয়েছে।

প্রতিটি বাড়িতে রেশম পোকা বিতরণ থেকে গুটি তৈরি পর্যন্ত সবকিছু তদারকি করে রেশম বোর্ড। পরে উৎপাদিত গুটি কৃষকদের কাছ থেকে কেজি দরে কিনে সুতা উৎপাদন করা হয়।

বছরে চারবার রেশম গুটি উৎপাদন করা যায়। প্রতি বছর ভাদ্র, অগ্রহায়ণ, চৈত্র ও জৈষ্ঠ্য মাসে রেশম গুটি সংগ্রহ করা হয়। কৃষকদের রেশম পোকার ডিম প্রদানের পর কয়েক দিনেই পোকা তৈরি হয়। পরে তুঁত গাছের পাতা কেটে কুচি কুচি করে পোকার খাবার সরবরাহ করা হয়। এভাবে দেড় মাসের মধ্যেই তৈরি হয় গুটি। যেখান থেকে তৈরি হয় রেশম সুতা। বর্তমানে এক কেজি সুতা বিক্রি হয় ৩ হাজার পাঁচশ টাকায়। প্রতি ৭ কেজি গুটি থেকে এক কেজি সুতা উৎপাদন করা যায়।

গাজীপুরের আঞ্চলিক কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, গ্রামের নারীদের স্বাবলম্বী করতেই রেশম চাষ সম্প্রসারণে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কয়েক বছরেই এ চাষের মাধ্যমে গাজীপুরের কাপাসিয়ার কয়েকশ নারী স্বাবলম্বী হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলেছেন। নিজ বাড়িতে সংসারের কাজের সাথেই এ চাষে সামান্য সময় দিয়ে সহজেই ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বাড়তি আয় করতে পারেন।

রেশম চাষের মাধ্যমে বিনা খরচে গ্রামের কৃষাণিদের কয়েক মাস পর পর ভালো টাকা আয় রোজগার করতে পারাটাই সরকারের স্বার্থকতা। তিনি আরো জানান, রেশম চাষের প্রধান রশদই হচ্ছে পোকার খাবার তুঁত গাছের পাতা। রেশম পোকার খাবারের সরবরাহের জন্য সরকারি বিভিন্ন খাল ও নদীর ধারে তুঁত গাছ রোপণ করা হচ্ছে। এতে কোনো জমিরও অপচয় হচ্ছে না।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রোগবালাই মুক্ত পরিবেশ পাওয়ায় চলতি বছর কক্সবাজারে সুপারির বাম্পার ফলন হয়েছে। জেলার আট উপজেলায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে চাষের বিপরীতে চলতি বছর সুপারি উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১২ হাজার মেট্রিকটন। উৎপাদিত সুপারি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সারাদেশে যাবার পাশাপাশি যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও।

বাজারদর হিসেবে চলতি বছরে উৎপাদিত সুপারি বিক্রয়ে প্রায় ২৪০ কোটি টাকা আয় হওবার সম্ভাবনা দেখছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এতে করে সুপারি চাষি পরিবার ও ব্যবসায়ীদের মাঝে স্বস্তি দেখা দিয়েছে। আর বাণিজ্যিক সুপারি উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে অনেকে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কক্সবাজার কার্যালয়ের উন্নয়ন শাখার উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা আশীষ কুমার দে জানান, কক্সবাজার জেলায় চলতি বছর ৩ হাজার ৫১৪ হেক্টর জমিতে সুপারি চাষ হয়েছে।

এতে টেকনাফে এক হাজার ২৬০ হেক্টর, উখিয়ায় ৯৭০ হেক্টর, কক্সবাজার সদরে ৬৭৫ হেক্টর, রামু উপজেলায় ৪০০ হেক্টর, মহেশখালীতে ১৫০ হেক্টর, চকরিয়ায় ৪০ হেক্টর, কুতুবদিয়ায় ১৩ হেক্টর ও পেকুয়ায় ৬ হেক্টর জমি সুপারি চাষের আওতায় আসে এ মৌসুমে। হিসাব মতে প্রতি হেক্টরে ৩ থেকে সাড়ে তিন টন সুপারি উৎপাদিত হয়েছে। সে অনুপাতে এবারের ফলন উঠবে প্রায় ১২ হাজার মেট্রিকটন।

প্রতিপণ (৮০পিস) বা কেজি প্রতি সুপারি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। এ হিসাবে এবারে সুপারি বিক্রি করে আয় হবে প্রায় ২৪০-২৫০ কোটি টাকার মতো। গত মৌসুমে সুপারি চাষের আওতায় ছিল ৩৪০০ হেক্টর জমি। কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁও বাজারের সুপারি ব্যবসায়ী নেতা মোহাম্মদ কালু (৫৮) বলেন, প্রাচীনকাল থেকে কক্সবাজারের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুপারি চাষ হয়ে আসছে।

বাড়িভিটার পরিত্যক্ত জমি, বাড়ির চালার কিনারা ঘেঁষা বা খেতের আটিতে সহজে সুপারি চারা রোপণ করা যায়। এভাবে চাষি পরিবারগুলো ছোট-বড় বাগান করে সুপারি উৎপাদন করতো। কিন্তু ৮০ দশকে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে বৈধ-অবৈধ পথে বিপুল পরিমাণ শুকনা সুপারি এদেশে আসতো।

চোরাই পথে আসা মিয়ানমারের সুপারি এদেশের হাট-বাজার সয়লাব হতো বলে দেশীয় উৎপাদিত সুপারি কম বাজারজাত হতো আর ন্যায্য মূল্য বঞ্চিত হতো ছোট-বড় চাষিরা। ফলে সুপারি চাষে অনেকটাই নিরুৎসাহিত হতো স্থানীয়রা। কিন্তু ১৯৯১ সালে বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা নাগরিক এদেশে আশ্রয় নেয়ার পর সে দেশ থেকে সুপারি পাচার ধীরে কমতে থাকে। এদিকে চাহিদা বাড়তে থাকে স্থানীয় সুপারির।

২০১৭ সালে আবারো বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রিত হবার পর সুপারির চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। এতে বেড়েছে সুপারির দামও। ফলে পরিত্যক্ত অকৃষি জমিগুলোতে সুপারির চাষাবাদ বাড়িয়েছে গৃহস্তরা। আর চলতি বছর সুপারির ফলন অন্য বছরের চেয়ে ভালো হয়েছে।

উখিয়ার পান-সুপারি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সুলতান আহমদ জানান, প্রতি মৌসুমে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন হাট বাজার হতে সুপারি ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহী ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন আড়তে চলে যায়। পরে ওইসব সুপারি প্রক্রিয়াজাত হয়ে রপ্তানির মাধ্যমে চলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।

অর্থকরী ফসল পান-সুপারি উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল এ দুই উপজেলার ৫ হাজারের মতো পরিবার রয়েছে। আর প্রায় প্রতিটি বসত ভিটায় চাষ হয় সুপারি। যা বিক্রি করে পরিবারের বাৎসরিক খরচের একটি মোটা অংশ যোগান এখান থেকে করছে তারা। এ বছর দুই উপজেলায় প্রায় শত কোটি টাকার সুপারি বাজারজাত হবে বলে আশা করছি আমরা।

মেরিন ড্রাইভের মনখালী এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছৈয়দ হোছাইন (৬০) বলেন, সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় সুপারির ফলন ভালো হয় দেখে অন্যদের মতো ভিটার পরিত্যক্ত জমিতে কিছু সুপারি গাছ লাগানো হয়েছিল। এখন প্রতিবছর ৬-৮ লাখ টাকার সুপারি বিক্রি করে পরিবারের খরচ যোগানোর বাড়তি অনুষঙ্গ হচ্ছে। তবে, সমুদ্র উপকূলে ঝাউগাছ নিধন অব্যাহত থাকায় লবণের তীব্রতায় অনেক সুপারি গাছে মড়ক দেখা দিয়েছে।

উখিয়ার মরিচ্যা বাজারে দেখা যায়, পাকা সুপারিতে সয়লাব হয়ে আছে বাজার ও আশপাশের খোলা জায়গা। একাধিক ট্রাক বোঝাই সুপারি দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী সেলিম উল্লাহ জানান, শুকানোর চেয়ে চাহিদার কারণে পাকা সুপারি প্রক্রিয়াজাত হিসেবে ভিজিয়ে রাখা হচ্ছে। মাস-তিনেক পর হতে ভিজানো সুপারি আবার বাজারজাত হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপ-পরিচালক মো. আবুল কাশেম বলেন, কৃষি নির্ভর অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে আমরা সবসময় সচেষ্ট রয়েছি। মৌসুমী অর্থকরী ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করতে মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের তৎপরতায় সুপারির বাম্পার ফলন হয়েছে। চলতি মৌসুমে দুই থেকে আড়াইশ কোটি টাকার সুপারি বিক্রয় হবে বলে আশা রাখছি।

সুপারি বাজারজাতে কৃষকেরা লাভবান হওয়ায় এলাকাভিত্তিক সুপারি চাষ ক্রমশ বাড়ছে, এটা আশা জাগানিয়া। এতে অকৃষি পরিত্যক্ত জমিগুলো উৎপাদনমুখী হচ্ছে। সবধরণের কৃষিপণ্য উৎপাদন বাড়াতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.