যেসব পাপে আল্লাহর অভিশাপ নেমে আসে

মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ

কিছু গুনাহ আছে, যা করলে মানুষের ওপর অভিশাপ নেমে আসে। অভিশাপকে আরবিতে বলা হয় ‘লানত’। নিম্নে এমন কিছু কাজের কথা আলোচনা করা হলো, যেগুলো আল্লাহর অভিশাপ ডেকে আনে।

১. কুফর ও শিরক অবস্থায় মারা যাওয়া : শিরক বা কুফরি করার পর তাওবা না করে মারা গেলে এমন ব্যক্তির ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হয়।

পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘নিশ্চয়ই যারা অবিশ্বাস করে এবং অবিশ্বাসী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তাদের ওপর আল্লাহর লানত এবং ফেরেশতা ও গোটা মানবজাতির লানত।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৬১-১৬২)

২. গাইরুল্লাহর নামে পশু জবাই করা : সালাত-সিয়াম, জবেহ-কোরবানি শুধু আল্লাহর নামে হতে হবে। এসব আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে করা হলে সেটা লানতের কারণ হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে জবাই করল তার ওপর আল্লাহ লানত বর্ষণ করেন।

’ (মুসলিম, হাদিস : ১৯৭৮)

৩. রাসুল (সা.)-এর নাফরমানি করা : যারা রাসুল (সা.)-এর নাফরমানি করে তাদের ওপর তিনি লানত করেছেন। আর তারা কিয়ামত দিবসে একে অন্যকে লানত করতে থাকবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যেদিন তাদের মুখমণ্ডল আগুনে ওলটপালট করা হবে, সেদিন তারা বলবে, হায়! যদি আমরা আল্লাহকে মানতাম ও রাসুলকে মানতাম! ‘তারা আরো বলবে, হে আমাদের রব! আমরা আমাদের নেতাদের ও বড়দের আনুগত্য করতাম। অতঃপর তারাই আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল।

হে আমাদের রব! তাদের তুমি দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং তাদের মহা অভিশাপ দাও।’ (সুরা ; আহজাব, আয়াত : ৬৬-৬৮)

৪. কবরকে সিজদার স্থান বানানো : কবরের ওপর বা কবরকে সামনে রেখে সিজদা করলে লানত বর্ষিত হয়। আবদুল্লাহ (রা.) ও আয়েশা (রা.) উভয়েই বর্ণনা করেছেন যে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা ইহুদি ও নাসারাদের ওপর লানত করেছেন। কারণ তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৩৫)

৫. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা : আল্লাহ তাআলা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীদের ওপর লানত করেছেন।

তিনি বলেছেন, ‘তবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সম্ভবত তোমরা জনপদে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। আল্লাহ এদের প্রতি লানত করেন। অতঃপর তাদের তিনি বধির করেন ও তাদের চোখ দৃষ্টিহীন করে দেন।’ (সুরা ; মুহাম্মাদ, আয়াত : ২২-২৩)

৬. বিপরীত লিঙ্গের বেশ ধারণ করা : যে নারী পুরুষের পোশাক গ্রহণ করে এবং যে পুরুষ নারীদের পোশাক, চালচলন নকল করে কিংবা অঙ্গবিকৃতি করে তাদের ওপর আল্লাহর রাসুলের লানত বর্ষিত হয়। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল (সা.) নারীর বেশ ধারণকারী পুরুষদের এবং পুরুষের বেশ ধারণকারী নারীদের অভিশাপ করেছেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৮৮৫)

৭. সমকামিতা : পুরুষে-পুরুষে ও নারীতে-নারীতে জৈবিক চাহিদা নিবারণের জন্য লজ্জাস্থান ব্যবহার করাকে সমকামিতা বলা হয়। এটি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর লানতের কারণ। ইবনু আববাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যারা সমকামী তাদের ওপর লানত বর্ষিত হোক।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৪৫৬)

৮. সতীসাধ্বী নারী ওপর অপবাদ দেওয়া : কোনো নারীর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিলে আল্লাহর লানত নেমে আসে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা সতীসাধ্বী, সরলা ঈমানদার নারীদের প্রতি (ব্যভিচারের) অপবাদ দেয়, তারা ইহকালে ও পরকালে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য আছে গুরুতর শাস্তি।’ (সুরা : নূর, আয়াত : ২৩)

৯. ঘুষ দেওয়া ও ঘুষ গ্রহণ করা : আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) বলেছেন, ‘ঘুষ আদান-প্রদান করা লানতের কারণ। হাদিসে এসেছে, ‘রাসুল (সা.) ঘুষদাতা এবং ঘুষগ্রহীতার ওপর লানত করেছেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৫৮০)

মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা : মদপান করা, মদ বহনকারী, মদ বিক্রেতা ইত্যাদি কাজে জড়িতদের ওপর আল্লাহর লানত। আনাস বিন মালেক (রা.) বলেন, ‘মদের সঙ্গে সম্পৃক্ত দশম শ্রেণির লোককে রাসুল (সা.) লানত করেছেন। মদ প্রস্তুতকারী, যে মদ প্রস্তুত করতে বলে, পানকারী, বহনকারী, যার জন্য বহন করা হয়, যে পান করায়, বিক্রয়কারী, এর মূল্য গ্রহণকারী, যে মদ ক্রয় করে এবং যার জন্য ক্রয় করা হয়।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২৯৫)

১০. জুলুম করা : জালিমদের ওপর আল্লাহ লানত করেন। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘জেনে রেখো! জালিমদের ওপর আল্লাহ লানত করেন।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ১৮)

১১. মানুষকে অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখানো : যে ব্যক্তি মানুষকে ধারালো হাতিয়ার দিয়ে ভয় দেখায় তার ওপর ফেরেশতারা লানত করে। ইবনে সিরিন (রহ.) থেকে বলেন, আমি আবু হুরায়রা (রা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রতি (লৌহ নির্মিত) অস্ত্র উত্তোলন করে সে তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত ফেরেশতারা তাকে লানত করতে থাকে, যদিও তার সহোদর ভাই হয়।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৬১৬)

১২. তাকদির বা ভাগ্য অস্বীকার করা : তাকদির বা ভাগ্য অস্বীকারকারী অভিশপ্ত। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ছয় ব্যক্তিকে আমি লানত করি, আল্লাহ তাআলা লানত করেন এবং প্রত্যেক নবী লানত করেছেন। (তারা হচ্ছে) আল্লাহর কিতাবে সংযোজনকারী, তাকদির মিথ্যা প্রতিপন্নকারী, শক্তি দ্বারা ক্ষমতা দখলকারী, যে ক্ষমতার বলে সে আল্লাহ তাআলা যাকে অপদস্থ করেছেন তাকে সম্মানিত করে এবং আল্লাহ যাকে সম্মানিত করেছেন তাকে অপদস্থ করে, আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তু হালাল জ্ঞানকারী, আমার পরিবার-পরিজনদের মধ্যে যাদের আল্লাহ হারাম করেছেন তাদের হালাল জ্ঞানকারী ও আমার সুন্নাত পরিত্যাগকারী।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২১৫৪)

১৩. জমির নিশানা পরিবর্তন করা : আবু তুফায়ল আমির ইবনে ওয়াসিলা (রহ.) বলেন, আমি আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বলল, নবী (সা.) আপনাকে আড়ালে কী বলেছিলেন? বর্ণনাকারী বলেন, তিনি রেগে গেলেন এবং বলেন, নবী (সা.) লোকদের কাছ থেকে গোপন রেখে আমার কাছে একান্তে কিছু বলেননি। তবে তিনি আমাকে চারটি (বিশেষ শিক্ষণীয়) কথা বলেছেন। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর লোকটি বলল হে আমিরুল মুমিনিন, সে চারটি কথা কী? তিনি বলেন, ১. যে ব্যক্তি তার মা-বাবাকে অভিসম্পাত করে, আল্লাহ তাকে অভিসম্পাত করেন, ২. যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে পশু জবাই করে আল্লাহ তার ওপরও অভিসম্পাত করেন, ৩. ওই ব্যক্তির ওপরও আল্লাহ অভিসম্পাত করেন, যে কোনো বিদাতি লোককে আশ্রয় দেয় এবং ৪. যে ব্যক্তি জমিনের (সীমানার) চিহ্ন অন্যায়ভাবে পরিবর্তন করে তার ওপরও আল্লাহ লানত করেন। (মুসলিম, হাদিস : ৫০১৮)

মহান আল্লাহ আমাদের লানত থেকে হেফাজত করুন।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.