মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে ডা. সঞ্জয় গুপ্ত যা বলেন

যুক্তরাষ্ট্রের ইমোরি ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের নিউরোসার্জন সঞ্জয় গুপ্ত। পঞ্চাশ বছর বয়সি এই চিকিৎসক মস্তিষ্কের টিউমার অপসারণ এবং অ্যানিউরিজমের (মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ থামানো) চিকিৎসার জন্য খ্যাত। এছাড়া তিনি একজন জনপ্রিয় টিভি ব্যক্তিত্ব। টিভিতে তার স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠান অসংখ্য পুরষ্কার জিতেছে।

সম্প্রতি তার চতুর্থ বই ‘কিপ শার্প: বিল্ড এ বেটার ব্রেইন এট এনি এজ’ প্রকাশিত হয়, যা নিউ ইয়র্ক টাইমসের সর্বোচ্চ বিক্রিত বইয়ের তালিকায় এক নম্বরে আছে। বইটিতে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য নিয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্য রয়েছে। এটা পড়ে পাঠকেরা মস্তিষ্ককে শাণিত করার উপায় সম্পর্কে জানতে পারবেন। এখানে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য রক্ষার্থে ডা. সঞ্জয়ের কিছু পরামর্শ দেয়া হলো।

* নিষ্ক্রিয়তাকে রোগ মনে করুন
ডা. সঞ্জয় বলেন, ‘আমি যতবারই বসতে যাই, প্রত্যেকবার নিজেকে প্রশ্ন করি: এখন কি আমার বসার প্রয়োজন আছে? কারণ হাঁটাচলা মস্তিষ্কের উপকার করতে পারে। তাই আমি অফিসে সবসময় বসে থাকি না।’ তিনি পরামর্শ দেন, ‘যদি পারেন তাহলে মিটিং, ফোন কল অথবা অন্যান্য কাজের সময় দাঁড়ান বা হাঁটুন। নিষ্ক্রিয়তাকে রোগ মনে করুন।’

* শরীরচর্চার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকুন
শরীরচর্চায় মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বাড়ে, প্রদাহ কমে ও নতুন কোষের বিকাশসাধন হয়। প্রতিসপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট শরীরচর্চার প্রয়োজন রয়েছে। ডা. সঞ্জয় বলেন, ‘আমি যেখানেই যাই না কেন, আমার সঙ্গে রানিং সুজ, সুইমসুট ও রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ড থাকে। আমার বেডরুমে ভারোত্তোলনের উপকরণ ও অফিসে পুলআপ বার রয়েছে।’

* হাঁটুন, কথা বলুন ও কষ্টের কথা জানান
কোনো বন্ধুর সঙ্গে দ্রুত হাঁটুন ও আপনার সমস্যা সম্পর্কে কথা বলুন। এটা হলো ব্রেইন ট্রাইফেক্টা: হাঁটাচলা, সামাজিকীকরণ ও মানসিক চাপ দূরীকরণ। ডা. সঞ্জয় বলেন, ‘কারো সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কষ্টের কথা বললে মানসিক চাপ কমে। এটা মস্তিষ্ককে বিষমুক্ত করে। আমি আগে একাকী শরীরচর্চা করতাম, কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে বেশি বেশি হাঁটাতে আমার মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যে সত্যিই পরিবর্তন এসেছে। আমি এটা অনুভব করতে পারি।’

* রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণ করুন
মস্তিষ্ককে রক্ষা করতে রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন রয়েছে। অতিরিক্ত শর্করা স্নায়ুকোষের মৃত্যু ও মস্তিষ্কের জ্ঞানীয় ক্ষয় ঘটাতে পারে। ডা. সঞ্জয় ডায়েট থেকে চিনি কমিয়েছেন। তিনি নিয়মিত সতেজ শাকসবজি (বিশেষত সবুজ রঙের শাকসবজি), বেরি ও অন্যান্য ফল, মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাবার, এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল ও ডিমের মতো স্বাস্থ্যকর চর্বি, বাদাম ও বীজ, মসুর ডালের মতো লেগিউম, বিনস, পোল্ট্রির মাংস, গোটা শস্য এবং সাধারণ দই/কটেজ চিজের মতো কম শর্করা ও কম চর্বির খাবার খেতে পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে, ভাজা খাবার, প্যাস্ট্রিজ, চিনিযুক্ত খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবার, লাল মাংস, উচ্চ চর্বির দুগ্ধজাত খাবার বা স্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার (যেমন- মাখন) ও লবণ কমিয়ে ফেলা উচিত।

* সাপ্লিমেন্ট এড়িয়ে চলুন
ডা. সঞ্জয় বেশিরভাগ সাপ্লিমেন্ট এড়িয়ে চলেন। তিনি পুষ্টির সাপ্লিমেন্টের পরিবর্তে পুষ্টিকর খাবার খেতে উৎসাহ দিয়েছেন। সাপ্লিমেন্টে নির্দিষ্ট কয়েকটি পুষ্টি থাকে, অন্যদিকে একটি স্বাস্থ্যকর খাবার থেকেই বহু রকমের পুষ্টি পাওয়া যায়। এছাড়া সাপ্লিমেন্ট ব্যবহারে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও রয়েছে অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদে সেবন করলে শরীরের অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। মস্তিষ্কের সুস্বাস্থ্যের জন্য ফিশ অয়েল ক্যাপসুলের তুলনায় সামুদ্রিক মাছ হাজারগুণে ভালো।

* খাবার খাওয়ার পরিবর্তে পানি পান করুন
ডা. সঞ্জয় বলেন, ‘আমরা প্রায়সময় পিপাসাকে ক্ষুধা ভেবে ভুল করি। শরীর পানিশূন্যতায় ভুগলে শক্তি নিঃশেষিত হয় ও মস্তিষ্কের ছন্দ ব্যাহত হয়।’ মস্তিষ্ক প্রধানত পানি দিয়ে গঠিত বলে মাত্র ২ শতাংশ পানিশূন্যতায় স্মরণশক্তি, কোনো কথা শোনার পর তাতে সাড়াদানের গতি ও বিশ্লেষণাত্মক চিন্তায় নিদারুণ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ডা. সঞ্জয় সবসময় সঙ্গে পানির বোতল রাখেন।

* বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটান
ডা. সঞ্জয়ের মতে, যারা সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখেন না অথবা বন্ধুবান্ধবকে সময় দেন না তাদের মস্তিষ্ক দ্রুত বুড়িয়ে যেতে পারে। তাই তিনি বর্তমানে মানুষের সঙ্গে সময় ব্যয় করাকেও প্রাধান্য দেন। তিনি নিজের বন্ধুবান্ধব ছাড়াও স্ত্রীর বন্ধুবান্ধব, সন্তানদের বন্ধুবান্ধব, তাদের পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন ও সমাজের মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক সম্পর্ক বাড়ালে আলঝেইমার্স ডিজিজের মতো স্মৃতিভ্রংশতার ঝুঁকি কমে যায়।

* ধ্যানে মগ্ন হোন
ডা. সঞ্জয় অ্যানালিটিকাল মেডিটেশন চর্চা করেন। তিনি দালাই লামা থেকে এই ধ্যান শিখেছেন। উভয়েই এটাকে কঠিন ধ্যান বলেছেন। এই ধ্যানে চোখ বন্ধ করে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে এমন একটি সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা হয় এবং এটাকে একটা বড়, স্বচ্ছ বাবলে রেখে অন্যসবকিছু থেকে পৃথক করা হয়। এটা আবেগ থেকে সমস্যাটিকে আলাদা করতে সাহায্য করে, যার ফলে যুক্তিসংগত সমাধান পাওয়া যায়। এই বিষয়ে অনলাইন থেকে বিস্তারিত জেনে নিতে পারেন।

* বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য খুঁজুন
ইকিগাই হলো একটি জাপানি শব্দ, যার অর্থ হলো- বেঁচে থাকার কারণ/উদ্দেশ্য। এটা ওকিনাওয়াতে ব্যাপকভাবে চর্চিত হয়, যেখানে স্মৃতিভ্রংশ রোগের হার খুবই কম। বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য সন্ধান করলে মস্তিষ্কের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে, অর্থাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ইকিগাই চর্চা করেন এমন মানুষদের মতে, এটা হলো সুখে থাকার সেরা একটি উপায়। ডা. সঞ্জয় মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য রক্ষার্থে ইকিগাই চর্চার পরামর্শ দিয়েছে। এটা আপনার কাছে নতুন বিষয় হলে অনলাইন থেকে জেনে নিতে পারেন।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.