ফিলিস্তিনের পক্ষে রাশিয়ার সুস্পষ্ট অবস্থান

পেপে এসকোবার

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ট্র্যাজেডিতে রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক নিরপেক্ষতার জটিল বিষয়টি অবশেষে গত সপ্তাহে স্পষ্ট হয়েছে। এখানে তিনটি বিষয় আমরা দেখব। প্রথমে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কথা। ৩০ অক্টোবর তিনি তাঁর দেশের নিরাপত্তা পরিষদ, শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা সংস্থার প্রধানের সমাবেশে বক্তব্য দেন। সেখানে একদিকে ইউক্রেন, অন্যদিকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন; এই দুটি যুদ্ধের বর্তমান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে রাশিয়ার অবস্থান পুতিন স্পষ্টভাবেই তুলে ধরেন।

পুতিনের ভাষায়, ‘গাজায় এখন যে ভয়ংকর ঘটনা ঘটছে, তার কোনো ন্যায্যতা নেই। সেখানে লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, যাদের বোমা হামলা থেকে পালানো বা আড়ালে যাওয়ার জায়গা নেই। আপনি যখন রক্তমাখা ও মৃত শিশু দেখেন; নারী ও প্রবীণের দুর্ভোগ দেখেন এবং আপনি যখন দেখেন চিকিৎসকদের হত্যা করা হয়েছে, তখন আপনার মুঠ শক্ত হয়ে আসবে এবং আপনাআপনি চোখে পানি চলে আসবে।’ পুতিন স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী ও তার অনুচরেরাই’ ‘বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীলতা ও রক্তাক্ত যুদ্ধের প্রধান সুবিধাভোগী।’ তাঁর ভাষায়– ‘তাদের কৌশলও পরিষ্কার। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং তার অবস্থান হারাচ্ছে। সবাই এটি দেখছে, এমনকি বিশ্ব অর্থনীতির প্রবণতা বিচার করেও এটি বুঝতে পারছে।’

গুরুত্বপূর্ণ হলো, পুতিন তাঁর অভ্যন্তরীণ ও গ্লোবাল সাউথের শ্রোতাদের জন্য এটিও স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী ও তার অনুচরেরাই ফিলিস্তিনিদের ট্র্যাজেডি এবং সাধারণভাবে মধ্যপ্রাচ্যে গণহত্যার পেছনে রয়েছে।’

বস্তুত এ থেকে যা বেরিয়ে আসে তা হলো, রাশিয়া দ্ব্যর্থহীনভাবে গ্লোবাল সাউথ তথা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতের পক্ষে; যেখানে আছে আরব বিশ্ব থেকে শুরু করে সব মুসলিম দেশ এবং তার বাইরে আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকা। মজার বিষয় হলো, রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদার ইরানের নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি এবং হিজবুল্লাহর হাসান নাসরুল্লাহর মতের সঙ্গে একমত হয়েছে মস্কো। গত শুক্রবার তাঁর তীক্ষ্ণ, পরিশীলিত, সান-জু স্টাইলের ভাষণে পুতিন বলেন, ‘মাকড়সা সব গ্রহ এবং সমগ্র বিশ্বকে তার জালে জড়িয়ে ফেলতে চেষ্টা করছে।’

এবার আসতে পারে রাশিয়ার দাপ্তরিক অবস্থানের কথা। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ে পুতিনের ভাষণের দু’দিন পর জাতিসংঘে রাশিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি স্পষ্ট করতে সক্ষম হন, দখলদার হিসেবে ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ নেই। ২০০৪ সালে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালতের পরামর্শমূলক রায় এটি সমর্থন করে। সেই সময়ে, আদালতে ১৫টির মধ্যে ১৪টি ভোটে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় যে, পূর্ব জেরুজালেমসহ অধিকৃত ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের প্রাচীর নির্মাণ আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি। মস্কোও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে ইসরায়েলের অধিকার স্বীকার করে– এমনটা বলার পাশাপাশি নেবেনজিয়া বলেন, এই অধিকার তখনই দেওয়া যাবে, যখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি সমস্যার ন্যায্য সমাধান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তিনি রেকর্ড দেখিয়ে বলেন, ফিলিস্তিন বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কোনো প্রস্তাবে ইসরায়েল সম্মান দেখায়নি।

তৃতীয় আলোকপাতের বিষয়, ইসরায়েল/ফিলিস্তিন বিষয়ে রাশিয়ার অবস্থান, যা পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ স্পষ্ট করেছেন। জাতিসংঘে নেবেনজিয়ার বক্তব্যের দুই দিন পর সের্গেই লাভরভ কুয়েতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাবাহ আল-সাবাহর সঙ্গে প্রেস কনফারেন্স করেন। সেখানে লাভরভ উল্লেখ করেন, পুতিন ও নেবেনজিয়ার বক্তব্যের মাধ্যমে মস্কোর অগ্রাধিকার স্পষ্ট করা হয়েছে। সেটা হলো: জরুরি ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা ও আলোচনা আবার শুরু করা, যাতে ‘জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৬৭ সীমানার মধ্যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। এর মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি ও নিরাপত্তার সহাবস্থানও নিশ্চিত হবে।’ লাভরভ জোর দিয়ে বলেন, বর্তমানে বেশ কিছু মার্কিন-ইসরায়েল কৌশল বাস্তবায়ন হচ্ছে, ‘যার উদ্দেশ্য হলো, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তকে বিলম্বিত করা (যদি দাফন না করা যায়)।’

ওপরের তিনটি বিষয়ে আলোকপাত এটাই স্পষ্ট করছে, চলমান খেলায় রাশিয়াই এগিয়ে আছে। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, গ্লোবাল সাউথ তথা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের অবস্থানও এটাই– গোঁড়া ও বিভাজনবাদী জায়নবাদী প্রকল্পটি এখন মৃত। ফিলিস্তিনের ন্যায়সংগত সমাধান ছাড়া দৃশ্যমান কোনো শান্তি ওই অঞ্চলে আসতে পারে না। গাজায় যে ভয়াবহতা চলছে, তাও প্রমাণ করছে, শান্তি যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার শান্তি নয়। এ অবস্থায় সম্ভবত চীনসহ রাশিয়ার হস্তক্ষেপে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে।

পেপে এসকোবার: ব্রাজিলিয়ান ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক, দ্য ক্রেডল থেকে সংক্ষেপিত, ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.