ডেঙ্গু বাংলাদেশের জন্য স্থানিক মহামারী

ডা. মুশতাক হোসেন

জনস্বাস্থ্য ও মহামারী বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন এখন বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআরের উপদেষ্টা। সম্প্রতি দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন অনেক মানুষ। এ পরিস্থিতিতে করণীয়সহ প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছেন ডা. মুশতাক হোসেন। তার সাক্ষাৎকারঃ

দেশ রূপান্তর : সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটে। এ বছর অক্টোবরের শেষ ভাগে এসেও ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমার লক্ষণ নেই। বরং কয়েক দিন ধরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কারণ কী?

ডা. মুশতাক হোসেন : প্রধান কারণ হচ্ছে বৃষ্টিপাত, জলবায়ু পরিবর্তন। বিশ্বব্যাপী এরকম হচ্ছে। বৃষ্টিপাত অনিয়মিত হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় আসছে। ঘূর্ণিঝড় যদি নাও আঘাত হানে নিম্নচাপের প্রভাবে কিন্তু কমপক্ষে সাতদিন বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির পানি জমে থাকা খানাখন্দ মশার প্রজননে খুবই উপযোগী। দ্বিতীয় হচ্ছে মশক নিয়ন্ত্রণ করায় এবং ডেঙ্গু রোগীদের ব্যবস্থাপনায় যে সর্বাত্মক উদ্যোগ, সেটা আমরা নিতে পারছি না। এখানে একজন রোগীর চিকিৎসা করবার জন্য নিয়মকানুন আছে, মানে হাসপাতালে রোগী এলো আর আপনি চিকিৎসা করলেন, কিন্তু যখন কমিউনিটিতে রোগ ছড়িয়ে পড়ে তখন স্থানীয়ভাবে মহামারীর সৃষ্টি হয়। ডেঙ্গু বাংলাদেশের জন্য একটা স্থানিক মহামারী। এ পরিস্থিতিতে রোগীর চিকিৎসা এবং ব্যবস্থাপনা ভিন্নভাবে করতে হয়। জনস্বাস্থ্যভিত্তিক ব্যবস্থাপনা নিতে হবে।

দেশ রূপান্তর : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনস্বাস্থ্যভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কী হতে পারে?

ডা. মুশতাক হোসেন : কমিউনিটি বা জনগোষ্ঠীভিত্তিক ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। সিঙ্গেল রোগীর চিকিৎসার যে প্রটোকল সেটা দিয়ে ডেঙ্গুর নিয়ন্ত্রণ হবে না। সিটি করপোরেশন কিছু কিছু এলাকায় করছে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট না। তাদের জনবল নেই, সম্পদ নেই। যে এলাকা থেকে ডেঙ্গু রোগী আসছে হাসপাতাল থেকে সেখানকার ঠিকানা নিয়ে তারা সে এলাকায় কীটনাশক ছিটানো, মানুষকে বলা এসব করছে। এটা ঠিক আছে, তবে তা খুবই সীমিত আকারে হচ্ছে। সরকার যদি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বাত্মকভাবে ঝাঁপিয়ে না পড়ে, তাহলে হবে না। এখন তো ঢাকার বাইরে অনেক জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। গণমাধ্যমে ৫০টির বেশি জেলার কথা বলা হয়েছে। এটা উপজেলা পর্যায়েও ছড়িয়েছে। এখন টানা দুই/তিন বছর যদি কমিউনিটি মবিলাইজেশন করে একটা হচ্ছে মশক নিয়ন্ত্রণ, আরেকটা হচ্ছে ডেঙ্গু রোগীদের সার্ভিলেন্স, মানে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করার কাজ করতে পারি তাহলেই এই যে প্রায় বছরই ডেঙ্গুর স্থানিক মহামারী হচ্ছে তা থেকে মুক্তি পেতে পারি।

দেশ রূপান্তর : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যারা সফল হয়েছে, তারা কীভাবে পেরেছে?

ডা. মুশতাক হোসেন : ডেঙ্গু রোগী কীভাবে শনাক্ত হয়, কীভাবে চিকিৎসা করা হয়, কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় সবকিছু কিন্তু জানা। কভিডের মতো অজানা রোগ না। যারা এটি নির্মূলে সফল হয়েছে যেমন কলকাতা, নিকারাগুয়া, কিউবা তারা কমিউনিটিভিত্তিক মবিলাইজেশন করে সফল হয়েছে। আমাদেরও এটা নির্মূলের সক্ষমতা আছে। আমাদের গ্রাসরুট লেভেল পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিরা আছেন। ইউপি লেভেলে চেয়ারম্যান, কাউন্সিলররা আছেন। অনেক বেসরকারি সংস্থাও আছে। গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত আছে। শহরাঞ্চলে এমন এলাকাভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক নেই। এটা অবিলম্বে করা দরকার। কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলে সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে এলাকার জনগণ সেখানে সম্পৃক্ত হয়। কারণ, তারা চোখের সামনে দেখে যে এই এই কাজগুলো করে মাত্র ৪/৫ জন লোক, তো আমরাও হাত লাগাই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্বেচ্ছাসেবী তারাও এগিয়ে আসেন। সাধারণভাবে ডেঙ্গুকে কেন্দ্র করে আমরা যদি এটা করি তাহলে অন্যান্য রোগ নিয়ন্ত্রণেও এটা ভূমিকা রাখবে।

প্রয়োজন হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ নজর দেওয়া। আমদের যে সম্পদ আছে সেটা যদি সমাবিষ্ট করা যায়, মবিলাইজড করা যায়, জনগণকে সম্পৃক্ত করা যায়, তাহলেই সম্ভব।

দেশ রূপান্তর : চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১০৬ জন, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিছু সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু ইউনিট খুলেছে। রোগীর অনুপাতে এটা কি পর্যাপ্ত বলে মনে করেন?

ডা. মুশতাক হোসেন : এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্ত। অন্যান্য হাসপাতালেও স্বল্প সময়ে সেটা করা যাবে। কিন্তু হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ফাঁকা করে ডেঙ্গু রোগীদের ইউনিট করলে বা তাদের ভর্তি করলে অন্য রোগী মানে সেসব ওয়ার্ডে যারা ছিল, তাদের চিকিৎসা ব্যাহত হবে। কিন্তু কমিউনিটি ভিত্তিক যদি আমি রোগী শনাক্ত করি, তাদের যদি আমি আগে থেকেই বলি যে কী করতে হবে তাহলে তো হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হবে না। তারা হাসপাতালে যাওয়ার আগেই স্বাস্থ্য পরামর্শ পেয়ে যাবে।

দেশ রূপান্তর : এবার রোগী বাড়ার কারণ কী?

ডা. মুশতাক হোসেন : কারণ হচ্ছে ডেঙ্গুর ভাইরাস নম্বর ৪ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। এটার সংক্রমণ বেশি হয়েছে। যারা দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছে তাদের অবস্থাই গুরুতর হচ্ছে। অনেকে তো জানেই না যে সে আগে আক্রান্ত হয়েছিল। হয়তো প্রথমবার তার জ¦রই হয়নি। মৃদু লক্ষণ ছিল, পরে ভালো হয়ে গেছে। এখন যদি সে ডেঙ্গু নম্বর ৪ দিয়ে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়, তাহলে তো তার অবস্থা গুরুতর হয়ে যাবে। এজন্যই আমরা যদি কমিউনিটি ভিত্তিক রোগী খুঁজতে থাকি তাহলে যারা আজ গুরুতর রোগী হয়ে হাসপাতালে আসছেন তাদের অনেকেই হাসপাতালে আসার আগেই চিকিৎসা পেয়ে যাবেন। প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে কমিউনিটি লেভেলে যদি মনিটরিংয়ে আনা যায় গুরুতর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমে যাবে বলে মনে করি।

দেশ রূপান্তর : আমরা এডিস মশার জন্ম ঠেকাতে পারলাম না, সিটি করপোরেশন মশা মারতে যে ওষুধ ছিটায়, তার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থার ব্যর্থতা কতটুকু? প্রযুক্তিগত কোনো সীমাবদ্ধতা কি আছে?

ডা. মুশতাক হোসেন : আমরা সফলভাবে অভিযান চালাতে পারিনি। কীটতত্ত্ববিদ আমাদের দেশে আছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা থেকেও পরামর্শক এসেছিল। তারা বেশ কিছু পরামর্শ দিয়ে গেছে। একটা উদাহরণ দিই তারা বলেছিল, আপনি উড়ন্ত মশাকে মারতে ধোঁয়ার মাধ্যমে কীটনাশক দেন, এখন ঢাকা শহরে ফ্ল্যাট বাড়ির সংখ্যা কত? ফ্ল্যাটের সর্বোচ্চ জায়গায় কি ধোঁয়াটা পৌঁছে? তো ঘরের মধ্যে ধোঁয়া পৌঁছাতে জনবল থাকতে হবে, ফ্ল্যাট মালিকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, তাদের সম্পৃক্ত করে ঘরে যেতে হবে। তারপর আপনি একটা এলাকায় কীটনাশক দিলেন, সেখান থেকে মশা চলে গেল। কিন্তু তিনদিন পর তো পাশের এলাকা থেকে আবার মশা চলে আসবে। ফলে, একযোগে আপনাকে পুরো শহরে এটা করতে হবে। তো হিসাব করেন একযোগে এটা করতে কত জনবল লাগবে, কত কীটনাশক লাগবে, সম্পদ লাগবে। একমাত্র জরুরি পরিস্থিতিতেই এটা করা সম্ভব। সরকার এটা জরুরিভিত্তিতে করতে পারে।

কীটনাশকের মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, পরিস্থিতি এখন উন্নত হয়েছে। এখন এদিকে সবার নজর আছে, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটি এগুলো পরীক্ষা করে, তারপর অনুমতি পায়। তবে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার জনবল এবং সম্পদের ঘাটতি আছে বলে মনে করি।

আমাদের প্রযুক্তির কোনো ঘাটতি নেই। আমরা জানি মশা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা কীভাবে করতে হয়। ঘাটতি হলো কমিউনিটি মবিলাইজেশনের। কমিউনিটিকে কাজে লাগিয়ে আপনি কাজ সমাধা করবেন। আপনি পত্রিকায়, টিভিতে প্রচার চালাবেন, বক্তৃতা করলেন এটাতে হবে না। আপনাকে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে নামতে হবে।

দেশ রূপান্তর : হাবীবুল্লাহ বাহার যখন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি এই ঢাকা শহরে মশা নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন, যা প্রবাদ হয়ে আছে। সে সময় পারলে এখন পারছি না কেন?

ডা. মুশতাক হোসেন : হাবীবুল্লাহ বাহারের সময় যেটা হয়েছে সেটা একেবারে কমিউনিটিকে সন্বিবিষ্ট করে হয়েছে। পাড়ার লোকজন নেমেছে, ছাত্র-যুবকরা নেমেছে। যেটা বললেন, পাকিস্তান আমলে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ এভাবেই হয়েছিল। কয়েক বছর আগে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নেতৃত্বে খুব সীমিত আকারে হলেও কমিউনিটি মবিলাইজেশনের কাজটা দেখিয়েছেন। সেটা ছিল উদাহরণ, পাইলট হিসেবে। হাবীবুল্লাহ বাহারের সময় সেটাই করা হয়েছে, তারা কমিউনিটিকে কাজে লাগিয়েছে। সঙ্গে কর্মকর্তারা, এক্সপার্টরা ছিলেন। এক্ষেত্রে উদ্যোগটা সরকার থেকে নিতে হবে। আমাদের পূর্বপুরুষরা যদি ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ করে ফেলতে পারেন, সেখানে ডেঙ্গু এখনো আমাদের শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ, আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কেন করতে পারব না!

দেশ রূপান্তর : সরকারের বিভিন্ন ভবনে, প্রকল্পে কাজ চলার সময়ও পানি ও ময়লা আবর্জনা জমে থাকে; যা থেকে এডিসের বংশবিস্তার ঘটে। আবার আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় দেখা গেছে, চিকিৎসাধীন ২৫ ভাগ ডেঙ্গু রোগী মশারি ব্যবহার করছেন না। করণীয় কী?

ডা. মুশতাক হোসেন : এখানেও সরকারি অফিসে যারা কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের মবিলাইজড করার বিষয়। হাসপাতালের ছাদে গিয়ে দেখেন, সেখানে বৃষ্টির পানি জমে কি না। সরকারি বহুতল অফিসের কথা বাদই দিলাম, থানার পাশে যেসব সিজ করা গাড়ি পড়ে থাকে, সেসব গাড়ির মধ্যে পানি জমে থাকে। তো কমিউনিটি মবিলাইজেশনের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তো পড়বেন। তার বিল্ডিংয়ের ছাদে, কার্নিশে, এসির নিচে পানি জমছে কি না, মশার বিস্তার হচ্ছে কি না সেসব দেখতে হবে। এটা সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে সম্ভব না, তার দায়িত্ব হতে পারে। সব জায়গায় নজরদারি চালাতে হবে। পাড়ায় কোনো সরকারি অফিস থাকলে সেখানে পানি জমে আছে কি না সেটা স্থানীয়রাও খোঁজ নিতে পারেন। ছাত্রছাত্রীদের সম্পৃক্ত করতে হবে।

আর মশারি তো সবার ব্যবহার করতে হবে। সুস্থ মানুষকেও দিতে হবে, ডেঙ্গু রোগীকেও দিতে হবে। এলাকার জনগণকে সম্পৃক্ত করা গেলে কার মশারি নেই, কাকে দিতে হবে তা বোঝা সহজ হবে। এলাকার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মশারি বিতরণ করতে হবে।

দেশ রূপান্তর : জনগণের সচেতনতার ঘাটতি আছে বলে মনে করেন কি?

ডা. মুশতাক হোসেন : সচেতনতা শব্দটি নিয়ে আপত্তি আছে। মবিলাইজড করা। জনগণকে সমাবিষ্ট করে জনগণকে কাজ দেওয়া, তাকে সম্পৃক্ত করে আগাতে হবে। সচেতনতা একটা বায়বীয় শব্দ। জনগণ যথেষ্ট সচেতন, তাদের কাছে টিভি আছে, পত্রিকা পড়ে, তারা জানে। আপনার তাদের সঙ্গে নিয়ে ড্রেন পরিষ্কার করতে হবে, কেবল টিভিতে বললে হবে না। তাকে গিয়ে বলতে হবে যে চলেন আমরা কাজে হাত লাগাই বা চলেন আপনার বাড়ির ছাদটা দেখে আসি।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.