ঐতিহাসিক রায়, হিন্দু বিধবার অধিকার স্বামীর সব সম্পত্তিতে

স্বামীর রেখে যাওয়া কৃষিজমিতে বাংলাদেশের হিন্দু বিধবা নারীদের আইনগত অধিকার দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, দেশে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী স্বামীর রেখে যাওয়া কৃষিজমিতে তাঁর বিধবা স্ত্রী অধিকারের দাবিদার। এত দিন বিধবা নারীরা শুধু অকৃষি জমির অধিকারী ছিলেন। এই রায়ের মাধ্যমে এখন স্বামীর সব সম্পত্তিতে হিন্দু বিধবা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠত হলো।

বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীর একক হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বুধবার এ রায় দেন। খুলনার বটিয়াঘাটার জ্যোতিন্দ্র নাথ মণ্ডলের করা আবেদন খারিজ করে ঐতিহাসিক এ রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালতে আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. আব্দুল জব্বার। বিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট নাফিউল ইসলাম। আদালতে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে অভিমত প্রদানকারী আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার উজ্জল ভৌমিক।

রায়ের পর ব্যারিস্টার উজ্জল ভৌমিক বলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক রায়। এই রায়ের ফলে বাংলাদেশের হিন্দু বিধবা নারীরা জীবদ্দশায় (জীবনস্বত্ব) তাঁর স্বামীর রেখে যাওয়া কৃষিজমি ভোগদখল করতে পারবেন। আইনগত প্রয়োজনে তা বিক্রিও করতে পারবেন। এত দিন বিধবা নারীরা শুধু অকৃষি জমির অধিকারী ছিলেন। এখন স্বামীর সব সম্পত্তিতে বিধবা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, বিধবার যদি একটি ছেলেসন্তান থাকে তাহলে ওই বিধবা নারী তাঁর ছেলের সমান সম্পত্তি পাবেন। বিধবার যদি তিনটি ছেলে থাকে, তাহলে সে সম্পত্তি সমান চার ভাগ হবে। দুই ছেলে থাকলে সমান তিন ভাগ হবে।

খুলনার বটিয়াঘাটার হালিয়া গ্রামের অভিমূণ্য মণ্ডল মারা যাওয়ার পর তাঁর রেখে যাওয়া কৃষিজমি তাঁর বিধবা স্ত্রী গৌরী দাসীর নামে রেকর্ড হয়। এই রেকর্ড সংশোধনের জন্য স্বত্ব ঘোষণা চেয়ে ১৯৯৬ সালে খুলনার সহকারী জজ আদালতে মামলা করেন গৌরী দাসীর দেবর জ্যোতিন্দ্র নাথ মণ্ডল। আদালত ওই বছরের ৩০ মে তাঁর আবেদন খারিজ করে দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে খুলনার যুগ্ম জেলা জজ আদালতে আপিল করেন জ্যোতিন্দ্র নাথ মণ্ডল। আবেদনে বলা হয়, ভারতীয় ফেডারেল আদালতের রায় অনুযায়ী, হিন্দু বিধবা নারী তাঁর স্বামীর কৃষিজমির অধিকারী নন। ওই আদালত ২০০৪ সালের ৭ মার্চ জ্যোতিন্দ্র নাথ মণ্ডলের আবেদন খারিজ করে দেন। এই আদালতের রায়ে বলা হয়, ভারতীয় ফেডারেল আদালতের রায় বাংলাদেশে প্রযোজ্য নয়। কারণ ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা এক নয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা এককেন্দ্রিক। আর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ভূমিসংক্রান্ত আইন করার অযোগ্যতা নেই। এরপর তিনি হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন ওই বছরই। সেই আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গতকাল তা খারিজ করে রায় দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট জমির স্বত্বসংক্রান্ত আগের দেওয়া রায় (৩৪ ডিএলআর-বিচারপতি মোস্তফা কামালের দেওয়া রায়), ১৯৩৭ সালের হিন্দু উইমেন্স রাইটস টু প্রপার্টি অ্যাক্ট, ফেডারেল আদালতের রায়, ১৯৭২ সালের অ্যাডাপটেশন ল অব বাংলাদেশ পর্যালোচনা করে দেওয়া এই রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, দেশে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী স্বামীর রেখে যাওয়া কৃষিজমিতে তাঁর বিধবা স্ত্রী অধিকারের দাবিদার।

ভারতবর্ষে স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তির ওপর হিন্দু বিধবা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৩৭ সালে হিন্দু উইমেন্স রাইটস টু প্রপার্টি অ্যাক্ট করা হয়। এই আইনে কৃষি ও অকৃষি জমির ওপর বিধবা নারীর অধিকার দেওয়া হয়। এই আইন চ্যালেঞ্জ করে ভারতবর্ষের ফেডারেল আদালতে মামলা করা হয়। ওই মামলায় ১৯৪১ সালে ফেডারেল আদালত রায় দেন। ওই রায়ে কৃষিজমিতে আইনে দেওয়া বিধবা নারীর অধিকার বাতিল করা হয়। রায়ে বলা হয়, কৃষিজমির বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের আইন করার এখতিয়ার নেই। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ১৯৩৭ সালের হিন্দু উইমেন্স রাইটস টু প্রপার্টি অ্যাক্ট কার্যকর (ধারণ) করা হয়। ফলে আইন অনুযায়ী স্বামীর রেখে যাওয়া কৃষি ও অকৃষি সম্পত্তিতে বিধবা হিন্দু নারীর অধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন আদালতে বাটোয়ারাসংক্রান্ত মামলা হতে থাকে। এসব মামলায় বাংলাদেশের হাইকোর্টের দুজন বিচারপতি (বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি মোস্তফা কামাল, পরবর্তী সময়ে দুজনই প্রধান বিচারপতি) দুই ধরনের রায় দেন। বিচারপতি হাবিবুর রহমান ভারতের ফেডারেল আদালতের রায় বহাল রাখেন আর বিচারপতি মোস্তফা কামাল ১৯৩৭ সালের আইন, যা বাংলাদেশ ধারণ করে, তা বহাল রাখেন। কিন্তু বাংলাদেশের হাইকোর্টে আরো মামলায় ভারতীয় ফেডারেল আদালতের রায় অনুসরণ করে রায় দেওয়া হয়। ব্যারিস্টার উজ্জল ভৌমিক জানান, এসব রায়ের ফলে কৃষিজমিতে হিন্দু বিধবা নারীর অধিকার নিয়ে অস্পষ্টতা দেখা দেয়। আজকের (গতকাল বুধবার) এই রায়ের ফলে সেই অস্পষ্টতা দূর হলো।

দেশের হিন্দু বিধবাদের স্বামীর সব সম্পত্তিতে আইনগত অধিকার নিশ্চিত করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন তাকে স্বাগত জানিয়েছেন মানবাধিকারকর্মী ও জাতীয় সংসদ সদস্য অ্যারোমা দত্ত। রায়টিকে একটি যুগান্তকারী রায় হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর সমানাধিকারের জন্য এটি একটি অসাধারণ রায়। এই রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। তিনি বলেন, ‘রায় প্রধানকারী বিচারপতি ও বিচারব্যবস্থার প্রতি আমি আমার গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। শ্রদ্ধা জানাচ্ছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি। এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় বলতে চাই, এই রায়টা যেন সবাই জানতে পারে। গ্রামগঞ্জের মানুষের কাছে যেন এই রায়টা পৌঁছায়। কারণ তারাই তো সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত। এ জন্য রায়টির বহুল প্রচার চাইব। আরেকটি বিষয়, রায়টি যেন কার্যকর হয়। সে জন্য মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা জরুরি। এর জন্য স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে কাজে লাগানো যেতে পারে।’

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.