আচরণ বদলাচ্ছে করোনাভাইরাস?

চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আবারো নতুন করে কিছু কভিড-১৯-এর রোগী পাওয়া যাচ্ছে। গুচ্ছ সংক্রমণের এসব ঘটনায় রোগীভেদে রোগটির লক্ষণও প্রকাশ পাচ্ছে ভিন্ন ভিন্নভাবে। এছাড়া নতুন আক্রান্তদের মধ্যে রোগটির লক্ষণও উহানে প্রথম সংক্রমণের সময়ে আক্রান্তদের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। লক্ষণের এ ভিন্নতার কারণে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, অজানা কোনো উপায়ে নিজেকে বদলে ফেলছে প্যাথোজেনটি (জীবাণু)। এর ফলে ভাইরাসটিকে দমনের পথ আরো জটিল হয়ে উঠছে বলে আশঙ্কা তাদের। খবর ব্লুমবার্গ।

জিলিন ও হেইলংজিয়াং নামের চীনা দুই প্রদেশে নতুন শনাক্তকৃত রোগীদের মধ্যে নেগেটিভ নিউক্লিক অ্যাসিড টেস্ট চালিয়ে দেখা গিয়েছে, তাদের দেহে ভাইরাসটি অনুমিত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে সুপ্ত অবস্থায় থাকছে। একই সঙ্গে এসব রোগীর সুস্থ হতেও সময় লাগছে বেশি। চীনের শীর্ষ মারাত্মক ব্যাধি চিকিৎসকদের অন্যতম কিউ হাইবো দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন চ্যানেলকে এ কথা জানিয়েছেন।

উহানে সংক্রমণ পরিস্থিতির শুরু থেকেই চিকিৎসাসেবা দিয়ে এসেছেন কিউ হাইবো। তিনি জানান, উহানে প্রথমবার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে যে পরিমাণ

সময় লাগত, উত্তরাঞ্চলীয় ওই দুই প্রদেশে নতুন সংক্রমিতদের মধ্যে এখন এ লক্ষণ প্রকাশ পেতে সময় বেশি লাগছে আরো এক-দুই সপ্তাহ। এ কারণে কর্তৃপক্ষের জন্য ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার আগেই সংক্রমণ শনাক্ত করাটাও এখন মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, সংক্রমিতদের লক্ষণ প্রকাশ পেতে যে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন পড়ছে, সে সময়ের মধ্যে তারা নিজ পরিবারসহ অন্যদের গুচ্ছ আকারে সংক্রমিত করেছে।

গত দুই সপ্তাহে জিলিন ও হেইলংজিয়াং প্রদেশের শুলান, জিলিন ও শেংইয়াং শহরে ৪৬টি নতুন সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। নতুন করে সংক্রমণ ছড়ানোয় ১০ কোটি মানুষ অধ্যুষিত এলাকাটিতে আবারো লকডাউন আরোপ করা হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না, ভাইরাসটি কি সত্যিই উল্লেখযোগ্য মাত্রায় নিজেকে বদলে ফেলছে কিনা। অন্যদিকে শুরু থেকেই ভাইরাসটির সংক্রমণ মোকাবেলা করার কারণে চীনা চিকিৎসকরা এর সামান্যতম পরিবর্তনও বেশ ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছেন।

চীনের মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশ হুবেইয়ের শহর উহানে কভিড-১৯-এর ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা মারাত্মক চাপে পড়ে যায়। সে সময় শুধু আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে চলে যাওয়া রোগীদেরই চিকিৎসাসেবা দিতে বাধ্য হচ্ছিলেন স্থানীয় চিকিৎসকরা। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ দুটির সংক্রমণ পরিস্থিতি এখনো হুবেইয়ের সঙ্গে তুলনা করার মতো পর্যায়ে যায়নি। গোটা হুবেই প্রদেশে নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছে ৬৮ হাজারের বেশি।

ভাইরাসটির আচরণে পরিবর্তন নিয়ে চীনা বিশেষজ্ঞদের এ নতুন পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে দেশে কভিড-১৯ মোকাবেলার বিষয়টি আরো চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ভাইরাসটির সংক্রমণে পর্যুদস্ত দেশগুলো এখন রোগটির প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের এক মহাসংগ্রামের মুখোমুখি। ভাইরাসটির সংক্রমণ শনাক্তকরণ ও এর জন্য পর্যাপ্ত পরীক্ষা চালানোয় সবচেয়ে বেশি সক্ষম দেশগুলোর একটি চীন। তার পরও এ দেশটিও নতুন করে দেখা দেয়া গুচ্ছ সংক্রমণ ঠেকাতে রীতিমতো হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী গবেষকরা এখন নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছেন, ভাইরাসটি আদতেই মানুষের মধ্যে সংক্রমণের হার আরো বাড়িয়ে তোলার মতো উল্লেখযোগ্য মাত্রায় নিজেকে বদলে ফেলছে কিনা। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু গবেষণায় এ ধরনের ধারণাকে অতিরঞ্জিত হিসেবে সমালোচনা করা হয়েছে।

কিউ হাইবো জানান, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ দুটিতে নতুন করে গুচ্ছ সংক্রমণের শিকার ব্যক্তিদের অধিকাংশেরই ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। অন্যদিকে উহানে শনাক্তকৃত রোগীদের মধ্যে একাধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার নজির রয়েছে। সেক্ষেত্রে তাদের হূিপণ্ড, কিডনি ও অন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার নজির দেখা গিয়েছে বেশি।

চীনা কর্মকর্তাদের ধারণা, নতুন করে গুচ্ছ আকারে সংক্রমিত ব্যক্তিদের সঙ্গে রাশিয়া থেকে সংক্রমণ নিয়ে আগত ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার সূত্র খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। বর্তমানে ভাইরাসে পর্যুদস্ত ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়া অন্যতম। জেনেটিক সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমেও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর রোগীদের দেহ থেকে পাওয়া ভাইরাসের সঙ্গে রাশিয়ায় সংক্রমিতদের দেহে পাওয়া ভাইরাসের মধ্যে হুবহু মিল পাওয়া গিয়েছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ দুটিতে গুচ্ছ আকারে সংক্রমিতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১০ শতাংশের অবস্থা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে গিয়েছে বলে জানা গিয়েছে। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে ২৬ জনকে।

নতুন এ গুচ্ছ সংক্রমণ প্রতিরোধে চীন বর্তমানে আগ্রাসী কিছু পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ দুটিতে লকডাউন ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রেল যোগাযোগ নেটওয়ার্ক। আবাসিক এলাকাগুলোর প্রবেশমুখ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। লকডাউন ফিরে আসায় স্থানীয়দের মধ্যে এক ধরনের হতাশাও ছড়িয়ে পড়ছে।

বিষয়টি নিয়ে চীনের আরেক শীর্ষ সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ উ আনহুয়া বলেন, সংক্রমণের শীর্ষবিন্দু পেরিয়ে এসেছে, এ কথাটা এখন ভাবাই অনুচিত। একই সঙ্গে জনগণের সতর্কতামূলক অবস্থান ত্যাগ করাটাও উচিত নয়। এ মহামারী যে আমাদের মধ্যে দীর্ঘদিন অবস্থান করবে, তার পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে।

এর মধ্যে আবার চলতি সপ্তাহেই বেইজিংয়ে দেশটির বার্ষিক রাজনৈতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কয়েক হাজার প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগদানের জন্য বেইজিংয়ে এসে হাজির হয়েছেন। নিজস্ব স্থিতিশীলতা ও নিয়ন্ত্রণ সবার সামনে উপস্থাপনের উদ্দেশ্যেই দেশটির সরকার নিয়মিত এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.