সামরিক জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ: মিয়ানমারে রক্তাক্ত দিনে গুলিতে ১১৪ জন নিহত

মিয়ানমারে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপনের মধ্যেই দেশজুড়ে জান্তা নিয়ন্ত্রিত নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে অন্তত ১১৪ বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। প্রতিবাদকারীদের মাথা ও বুকে গুলির হুমকি উপেক্ষা করে শনিবার সারাদেশে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ হয়। এসব বিক্ষোভ দমনের নামে নির্বিচারে গুলি চালায় সেনা নিয়ন্ত্রিত নিরাপত্তা বাহিনী।

এদিকে, শনিবার জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং দেশটির জনগণকে সুরক্ষার এবং গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এরপরই এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এজন্য তার এ বক্তব্যকে লজ্জা বা প্রহসন বলে আখ্যা দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। খবর রয়টার্স, মিয়ানমার নাউ ও এএফপির।

গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। এরপর শুরু হওয়া টানা বিক্ষোভে গতকালই সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে, গণতন্ত্রপন্থি বিক্ষোভকারীদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যার প্রতিশোধ নিতে দেশটির বিদ্রোহী সশস্ত্র দলগুলো ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে একটি সেনা পোস্টে হামলা চালিয়ে একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেলসহ ১০ সেনাসদস্যকে হত্যা করার দাবি করেছে। এ বিষয়ে জানতে রয়টার্স থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সাড়া পাওয়া যায়নি।

শনিবার ইয়াঙ্গুন, মান্দালয়সহ বিভিন্ন শহরে হত্যার হুমকি উপেক্ষা করে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী রাস্তায় নেমে জান্তাবিরোধী মিছিল করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিক্ষোভের সময় নিরাপত্তা বাহিনী প্রতিবাদকারীদের ওপর চড়াও হয়।

ইয়াঙ্গুনের দালা শহরতলির একটি থানার বাইরে বিক্ষোভের সময় এলোপাতাড়ি গুলি চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। এতে চার বিক্ষোভকারী নিহত এবং অন্তত ১০ জন আহত হন। বাণিজ্যিক এ রাজধানীর উত্তর দিকের জেলা ইনসেইনে বিক্ষোভে গুলি চালালে সেখানে অন্তত তিনজন নিহত হন। একজন প্রত্যক্ষদর্শী রয়টার্সকে জানান, নিহত তিনজনের মধ্যে স্থানীয় একটি অনূর্ধ্ব-২১ ফুটবল দলের এক খেলোয়াড়ও রয়েছেন।

মিয়ানমারের স্থানীয় সংবাদমাধ্যগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্বাঞ্চলীয় শহর লাসিওতে তিনজন, ইয়াঙ্গুনের কাছে বাগো অঞ্চলে চারজন ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় হোপিন শহরে এক বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। আর ইয়াঙ্গুনে সব মিলিয়ে অন্তত ২৪ প্রতিবাদকারীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
মিয়ানমার নাউ জানায়, মান্দালয়ের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ২৯ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী একটি শিশুও রয়েছে। এ ছাড়া সাগাইং শহরে বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছে। তবে সেখানে কতজন হতাহত হয়েছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

মিয়ানমার নাউ দাবি করেছে, শনিবার সব মিলিয়ে অন্তত ৯১ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। তবে রয়টার্স নিহতের এ সংখ্যা সঠিক কিনা, তা নিরাপেক্ষ সূত্র থেকে যাচাই করতে পারেনি। সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্রের কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চেয়ে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

আর বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলির ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। শনিবার সংস্থাটি বলছে, সেনাবাহিনীর সহিংসতায় বহু নিহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকশিনারের কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘দেশজুড়ে অন্তত ৪০ স্থানে শিশুসহ বহু নিহত, শত শত বিক্ষোভকারী আহত, গণগ্রেপ্তারের খবর পাচ্ছি আমরা।
এদিকে, ক্ষমতাচ্যুত আইনপ্রণেতাদের জান্তাবিরোধী গোষ্ঠী সিআরপিএইচের মুখপাত্র ড. সাসা বলেছেন, ‘আজ (শনিবার) সশস্ত্র বাহিনীর জন্য লজ্জা দিবস। চারশর বেশি নিরপরাধ বেসামরিক মানুষকে হত্যার পর সামরিক বাহিনীর জেনারেলরা সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালন করছেন।

সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে মোট নিহতের সংখ্যা এখন চারশ ছাড়িয়ে গেছে। দেশটির স্বাধীন পর্যবেক্ষক সংস্থা অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি) এক বিবৃতিতে জানায়, শুক্রবার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৩২৮ ছিল।

এর আগে শুক্রবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত এক সতর্কবার্তায় বিক্ষোভকারীদের বলা হয়েছে, ‘আপনাদের এর আগের মৃত্যুগুলো থেকে শেখা উচিত যে, আপনারা মাথা ও পিঠে গুলিবিদ্ধ হওয়ার মতো বিপদে পড়তে পারেন।’ অবশ্য এই সতর্কবার্তায় এটি উল্লেখ করা হয়নি যে, বিক্ষোভ দমন করতে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে গুলি করে হত্যার নির্দেশনা আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হয়েছে কিনা। তবে সেই সতর্কবার্তা অগ্রাহ্য করেই গতকাল রাস্তায় নামেন বিক্ষোভকারীরা।

অন্যদিকে, শনিবার সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে রাজধানী নেপিদোতে সামরিক কুচকাওয়াজ ও সামরিক শক্তি প্রদর্শনী হয়। এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন দেশটির শীর্ষ জেনারেল মিন অং হদ্মাইং। এ সময় তিনি নির্বাচন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কবে ভোট হবে, সে সম্পর্কে কিছুই বলেননি।

জান্তাপ্রধান বলেন, ‘গণতন্ত্রের সুরক্ষায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী পুরো জাতির সঙ্গে হাতে হাত রেখে কাজ করতে চায়।’ এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘যে দাবিতে নৃশংস কর্মকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে, যার ফলে দেশের স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা বিঘ্ন হচ্ছে, সেটা সঠিক দাবি নয়।’

এদিন, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের ‘ব্যাখ্যা’ দেওয়ারও চেষ্টা করেন হ্লাইং। তিনি বলেন, অং সান সু চি এবং তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির ‘বেআইনি কার্যকলাপের’ কারণে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে অভ্যুত্থান ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্যাতনের প্রতিক্রিয়ায় এরই মধ্যে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সেনা পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.