মাশরুম চাষে সফল কলেজছাত্র সাগর

সাগর হোসেন। বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের হোগলা গ্রামে। দুই ভাইয়ের মধ্যে সাগর বড়। তিনি ২০১৫ সালে মাধ্যমিক এবং ২০১৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন অর্থনীতি বিভাগে (অনার্স) রাজবাড়ী সরকারি কলেজে। বর্তমানে ওই কলেজে চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তিনি। ছাত্রজীবনে নিজেকে গড়ে তুলেছেন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। নিজ বাড়িতে মাশরুম চাষ করে এখন তিনি বছরে লাভ করছেন ৮-১০ লাখ টাকা। তার দেখাদেখি এলাকাসহ আশপাশের বেশ কয়েকজন গড়ে তুলেছেন মাশরুমের বাণিজ্যিক খামার।

বাণিজ্যিকভাবে উৎকৃষ্ট মানের সাগরের উৎপাদিত মাশরুম এখন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয়। নিয়মিত তার খামারে ৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। সাগরের পাশাপাশি তাদের পরিবারেও এসেছে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা।

২০২১ সালে বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনা মহামারি দেখা দেওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। তখন বাড়িতে বেকার বসে না থেকে এ মাশরুম চাষ করেন সাগর।

উদ্যোক্তা সাগর হোসেন বলেন, ‘করোনাকালীন সময়ে কলেজ বন্ধ হওয়ায় বাড়িতে চলে আসি। বাড়িতে অবসর সময় কাটাতাম। একদিন মোবাইলে মাশরুম চাষের ভিডিও দেখি। সেখান থেকে ইচ্ছা হয়, আমি যদি মাশরুম চাষ করি, তাহলে ভালো হবে। চাকরি করা কিংবা এলাকার বাইরে থাকার ইচ্ছা আমার কোনোদিন ছিল না। তাই যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে মাশরুম চাষ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নিয়ে ছোট আকারে ২০০টি ওয়েস্টার পিও-২ জাতের মাশরুমের স্পোন নিয়ে আমি বাড়িতেই কাজ শুরু করি। এরপর মাশরুম চাষের বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হই। উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে আমি জানতে পারি, যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের মাশরুম চাষে অধিকতর প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সুবিধা দিয়ে থাকে। তারপর উক্ত প্রকল্প থেকে আমি প্রশিক্ষণ নিয়ে, টিউশনি করে জমানো টাকা ও বাবার কাছ থেকে ধার নিয়ে মোট ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগে ২০ শতাংশ জমির টিনশেড ঘরে মাশরুম চাষ শুরু করি।’

তিনি বলেন, ‘যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণের পর আমি নিজেই মাশরুমের বীজ উৎপাদন শুরু করি। এখন এখান থেকে অনেকে বীজ কিনে নিয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘মাশরুম শীতকালে বেশি উৎপাদন করা যায়। এখন আমার এখানে ১৫ হাজার মাশরুমের বীজ প্যাকেট রয়েছে এবং ৮ হাজার মাশরুমের স্পোন রয়েছে। এসব স্পোন থেকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ কেজি মাশরুম উৎপাদন হয়। মাসিক হিসাবে এখান থেকে শীতের ৬ মাস প্রতিদিন ১০০ কেজির মতো মাশরুম পাওয়া যাবে, আর গরমকালের ৬ মাস ১০-১৫ কেজি। গড়ে পাইকারি ২০০-২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি খামার থেকে।’

প্রথম বছরে মাত্র ২০ শতাংশ জমিতে টিন ও বাঁশের তৈরি মাশরুমের চাষঘর থেকে ৯ লাখ টাকা আয় হয়। পরে বছর ২০২২ সালে ২০ লাখ টাকার মতো আয় হয়। এবার আরও বাড়বে বলে আশা করেন তিনি।

সাগর হোসেন বলেন, ‘চাকরির পিছনে না ছুটে আমরা যদি একটু দেখে-শুনে কোনো কিছুর উদ্যোগ নেয় গ্রহণ করি তাহলেই নিজের পাশাপাশি এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। মাশরুম চাষ লাভজনক। এর মাধ্যমে নিজের পাশাপাশি অনেক বেকাদের বেকারত্ব দূর করা যায়।’

সাগরের মাশরুম খামারে প্রায়ই সহযোগিতা করে সাগরের ছোট ভাই জীবন। জীবন জানান, এখনে থেকে ভাই এর কাছ থেকে মাশরুম চাষ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছেন। নিজে এখন বীজ তৈরি করতে পারেন। ভবিষ্যতে খামারটা আরও বড় আকারে করবেন তিনি।

মাশরুম চাষি সাগরের সাফল্য দেখে এলাকার অনেকে এখন মাশরুম চাষের জন্য আগ্রহী হয়েছেন। বেশ কয়েকজন যুবক করেছেন নতুন খামার। আর নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির পাশাপাশি এসব মাশরুম চাষিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করছে এবং প্রদর্শনীর মাধ্যমে সহযোগিতা করছে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প।

একই উপজেলার দুর্গাপুর এলাকার রায়হান আলী। তিনি এবার উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প থেকে মাশরুম চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে সাগরের কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করে খামার করেছেন।

রায়হান আলী বলেন, ‘আমি নতুন হিসাবে ২০০ প্যাকেট স্পোন নিয়ে মাশরুমের চাষ শুরু করেছি। কৃষি অফিস ও সাগর আমাকে পরামর্শ প্রদান করে। আগামীতে আমিও বীজ উৎপাদন করে বিক্রি করতে পারব বলে আশা করি।’

সাগরের মাশরুম খামারে দুই বছর ধরে মাসিক বেতনে কাজ করেন জাহিদুল ইসলাম জনি। তিনি বলেন, ‘করোনার মধ্যে যখন কাজ নেই, তখন সংসারে অভাব দেখা দেয়। তখন এই মাশরুমের খামারে কাজ শুরু করি। তখন থেকে মাসিক বেতন হিসাবে কাজ করি। এখান থেকে আমার সংসার চলে।’

পড়ালেখার পাশাপাশি মাসিক বেতনে সাগরের মাশরুম খামারে অবসর সময়ে মাসিক বেতনে কাজ করে স্কুলছাত্র সোহান। এখান থেকে তার পড়াশোনার খরচের পাশাপাশি হাতখরচও চলে।

যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন সহযোগী পরিতোষ কুমার মন্ডল বলেন, ‘নিয়মিত আমি সাগরের খামার পরিদর্শন করি এবং পরামর্শ প্রদান করি। যাতে তিনি আরও ভালো মাশরুম উৎপাদন করতে পারেন, সেই পরামর্শ দেই।’

কুমারখালী উপজেলা কৃষি অফিসার দেবাশীষ কুমার দাস বলেন, ‘আমরা কৃষি অফিস থেকে মাশরুম চাষি সাগরকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছি। তিনি ছাত্র জীবনে মাশরুম চাষ করে বেশ সাফল্য অর্জন করেছেন। সেইসঙ্গে তার দেখাদেখি উপজেলার অনেক তরুণ ও কৃষকরা মাশরুম চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় আমরা মাশরুম চাষিদের প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনী দিয়ে সহযোগিতা করছি।’

কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিতান কুমার মন্ডল জানান, লক্ষ্য অটুট থাকলে কোনো বাধাই শেষ পর্যন্ত বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। সেটা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন কুমারখালীর আত্মপ্রত্যয়ী যুবক সাগর হোসেন। উদ্যোক্তাদের পণ্যের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে উপজেলা প্রশাসন ইতোমধ্যে উদ্যোক্তা অ্যাপস ও ম্যাপসের ব্যবস্থা করেছে। এ ছাড়া প্রয়োজনে উদ্যোক্তাদের সহজশর্তে ঋণও দেওয়া হচ্ছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. হায়াত মাহমুদ জানান, মাশরুম চাষ লাভজনক। মাশরুম চাষের জন্য মাটির প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়া বাড়িতে এ চাষ করা সম্ভব বিধায় মহিলারাও এ চাষ করতে পারে। কুমারখালীর সাগর ছাত্রজীবনে মাশরুম চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। জেলা জুড়েই মাশরুম চাষ সম্প্রসারণে কাজ চলছে।

যশোর অঞ্চলে টেকসই প্রকল্পের জুনিয়র পরামর্শক ইমরুল পারভেজ বলেন, ‘অত্র প্রকল্পের আওতায় পণ্যের মূল্য সংযোজন ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করছি। সেই সঙ্গে উচ্চমূল্যের সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণে কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করছি। মাশরুম চাষ সম্প্রসারণ, বাজারজাতকরণ এবং এর মুল্য সংযোজনে কাজ করছে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প।’

যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ জানান, মাশরুম চাষে কুমারখালী উপজেলার সাগর হোসেন সাফল্য অর্জন করেছে। তার দেখাদেখি অনেক যুবক মাশরুম চাষে উৎসাহী হয়েছে।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.