পাহাড়ের প্রতিকূলতা ছাপিয়ে অতন্দ্র প্রহরী জওয়ানরা

চারদিকে ছোট-বড় পাহাড়। গহিন পাহাড়কে গভীর আলিঙ্গন করেই নদী-খাল, ঝিরি এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে। কখনও নীল আকাশ উঁচু পাহাড়ের সঙ্গে খেলে লুকোচুরি। এমন অনিন্দ্যসুন্দর নৈসর্গিক পরিবেশে সীমান্তের কোল ঘেঁষে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) উলুছড়ি বিওপি। ওপাশে ভারতের মিজোরাম। সরু একটি খাল বাংলাদেশ-ভারতের সীমানারেখা। পাহাড়ের টিলার ওপর রাঙামাটির উলুছড়ির বিওপিতে বিজিবি সদস্যদের আবাসস্থল।

দুর্গম হওয়ায় আধুনিকতার অনেক কিছুই নেই সেখানে। সীমান্তরক্ষীরা তাদের স্বজনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে যোগাযোগ রাখেন। উলুছড়িতে বাঙ্কারে ভারী অস্ত্র নিয়ে সতর্ক পাহারায় বিজিবি সৈনিকরা। সেখানকার প্রতি ইঞ্চি ভূমির দারুণ ব্যবহার করছেন জওয়ানরা। এক পাশে লাউয়ের মাচা, অন্য পাশে কবুতর ও ছাগল পালন করা হচ্ছে। প্রতি ফোঁটা পানির মূল্য সেখানে অসীম। প্রয়োজন ছাড়া এক ফোঁটা পানিরও অপচয় নেই। পাহাড়ের ঝিরির পানিতে সৈনিকরা সারাবছর গোসল সারেন। নিজস্ব পদ্ধতিতে ঝিরির পানি বিশুদ্ধ করে পান করা হয়। গত শনিবার রাঙামাটির বরকল ব্যাটালিয়নের উলুছড়ি এবং কাপ্তাই ব্যাটালিয়নের প্যারাছড়া বিওপিতে সরেজমিন দেখা যায়, প্রতিকূল পরিবেশেও জওয়ানরা অতন্দ্র প্রহরী।

উলুছড়িতে বিজিবির ২৪ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। সেখানে কথা হয় সিপাহি আশরাফুলের সঙ্গে। ফরিদপুরের সালথায় তাঁর গ্রামের বাড়ি। মার্চে উলুছড়িতে যোগ দেওয়ার পর থেকে এখানে তাঁর অন্যরকম জীবন। দুর্গম হওয়ায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। ঈদের দিন বিওপিতে পোলাও, গরু, খাসি, মুরগি, জর্দা, মিষ্টিসহ বাহারি খাবারের আয়োজন ছিল। দুর্গম হওয়ায় মাসে একবার বিওপির সবার জন্য রেশন পৌঁছে দেওয়া হয়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে কখনও রেশন যেতে দেরি হলে পাহাড়ের বাসিন্দাদের কাছ থেকে টুকটাক জিনিসপত্র কিনতে হয়।

নেত্রকোনার কলমাকান্দার বাসিন্দা সিপাহি প্রণয় সাহা বলেন, স্যাটেলাইট প্রযুক্তির মাধ্যমে অডিও করা যায়। দিনে-রাতে মিলে আট ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করি। সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবাহ করা হয় বিওপিতে।

নায়েক মহসিন আলম বলেন, উলুছড়ি থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে কাপ্তাই। কোনো জরুরি প্রয়োজনে কাপ্তাই যেতে হলে হেঁটে ৪৮ ঘণ্টা লাগে। আগে চার দিন লাগত। কোনো কোনো জায়গায় রাস্তা হওয়ায় এখন কিছুটা সময় কম লাগছে। সীমান্ত সড়ক হয়ে গেলে শহরের সঙ্গে যোগাযোগ আরেকটু সহজ হবে।

এর আগে প্যারাছড়া বিওপিতে গিয়ে দেখা যায়, মাটির মেঝে, ওপরে টিনের চালা। টিনের চালার নিচে শামিয়ানা। এমন পরিবেশে কাঠের ছোট বিছানা। কারও বিছানার পাশে প্লাস্টিকের ড্রয়ার। নিত্যদিনের জিনিসপত্র সেখানে রাখা। ছোট্ট একটি ড্রয়ারে রাখা প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম। হৃদরোগে আক্রান্ত হলে করণীয় সম্পর্কে একটি নির্দেশিকাও ঘরের বাঁশের বেড়ায় সাঁটানো।

সীমান্ত এলাকায় দায়িত্ব পালনের জন্য বিজিবি সদস্যদের দেশের প্রত্যন্ত ও দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থান করতে হয়। এর মধ্যে অনেক সীমান্ত এলাকায় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নেই। এতে অপারেশনাল ও প্রশাসনিক কাজে বিজিবিকে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।

বর্তমানে বিজিবির ৫০টির বেশি দুর্গম এলাকার বিওপিতে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। এতে অপারেশনাল ও প্রশাসনিক সক্ষমতা বেড়েছে অনেক। সৈনিকদের মনোবল দৃঢ় ও কর্মস্পৃহাও বেড়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সংযোগের মাধ্যমে বিওপিতে তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতা সাধনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহার করে ভিডিও এবং ডেটা ও ইন্টারনেট সংযোগ সংযোজিত হয়েছে। এর ফলে রিয়েল টাইম তথ্য আদান-প্রদান, কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোলের দৃঢ়তা, ম্যাপ অ্যানালাইসিস এবং অপারেশনাল মুভমেন্ট ও মনিটরিং অনেক সহজ হয়েছে। অন্যান্য যোগাযোগহীন বিওপিতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর সহায়তার মাধ্যমে টার্মিনাল স্থাপনের কাজও প্রক্রিয়াধীন।

বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী গত শনিবার পরিদর্শন করেন রাঙামাটি সেক্টর সদরদপ্তর। সব পর্যায়ের বিজিবি সদস্যের দরবার গ্রহণ করেন। দরবারে রাঙামাটি সেক্টরের আওতাধীন ব্যাটালিয়ন ও বিওপিতে কর্মরত সব পর্যায়ের বিজিবি সদস্য ভিটিসির মাধ্যমে সংযুক্ত ছিলেন। এর পর বিজিবি মহাপরিচালক প্যারাছড়া ও উলুছড়ির মতো দুর্গম বিওপি পরিদর্শনে যান। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করা ছাড়াও সৈনিকদের সুখ-দুঃখের কথা শোনেন তিনি। উলুছড়ির ক্যাম্পে দুপুরে সৈনিকদের সঙ্গে এক টেবিলে খাবার গ্রহণ করেন বিজিবি মহাপরিচালক। এর আগে সৈনিকদের বসবাসের স্থানসহ দুই বিওপির পুরোটা পরিদর্শন করেন। খোঁজ নেন সৈনিকদের পরিবারের সদস্যদের। সততা-নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের কথা স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।

এ সময় মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দেশপ্রেম, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করায় বিজিবি সদস্যদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেএনএফের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে। বিজিবিসহ অন্যান্য বাহিনী সার্বিকভাবে অভিযানে অংশ নিচ্ছে। কেএনএফের দৌরাত্ম্য ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নির্মূল করা হবে।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.