চিত্রকলার ইতিহাস, ফুলপরির ১০০ বছর

‘ফেয়ারিকোর’ এখনকার সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ জনপ্রিয় বিষয়। কিন্তু ১০০ বছর আগেই যুক্তরাজ্যজুড়ে অতিপ্রাকৃত এই চরিত্ররা ছিল জাতীয় মুগ্ধতার বিষয়। সেই ফেয়ারি বা পরি ম্যানিয়া ছড়িয়ে গিয়েছিল বিশ্বজুড়ে। ‘পরি’ কথাটি কল্পনা করতেই ব্রিটেনের কয়েকটি প্রজন্মের মানুষের মনের চোখে ফুটে ওঠে একটি ছোট, সুন্দর, জাদুকরী শিশু চরিত্রের চেহারা।

তার ছোট শরীরের পেছনে প্রায় ফড়িংয়ের মতো হাল্কা ডানা আর পরনে যেন ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরি পোশাক। পরির এই ছবিটি ব্রিটিশদের মাথায় গেঁথে গেছে শিল্পী সিসেলি মেরি বার্কারের কাজ থেকে। ব্রিটিশ এই অঙ্গসজ্জাকর চিত্রশিল্পীই ‘ফ্লাওয়ার ফেয়ারিজ’ চরিত্রের স্রষ্টা। এ বছরই তাঁর কবিতা ও ছবির প্রথম বই ‘ফ্লাওয়ার ফেয়ারিজ অব দ্য স্প্রিং’ (বসন্তের ফুল পরিরা) প্রকাশের ১০০ বছর পূর্ণ হলো।

যুক্তরাজ্যের শিল্পাঙ্গনে গুরুত্বের সঙ্গেই উদযাপিত হচ্ছে এই বার্ষিকী। ইংল্যান্ডের মার্সিসাইডের লেডি লিভার গ্যালারিতে এ উপলক্ষে চলছে এক বিশেষ প্রদর্শনী। ১০০ বছর আগের ঘটনা হলেও ‘ফ্লাওয়ার ফেয়ারিজ’-এর প্রভাব ব্রিটিশ সমাজে অম্লান। ১০০ বছর ধরে বরাবরই বাজারে ছিল এর প্রিন্ট।

বিশ্বজুড়ে এখনো এটি জনপ্রিয়। বিশেষ করে জাপান আর ইতালিতে। ইতালিতে বিখ্যাত ফ্যাশন হাউস গুচি ২০২২ সালে মেরি বার্কারের ছবিওয়ালা শিশুদের পোশাক ছাড়ে। সম্প্রতি পপ তারকা বিলি আইলিশ তাঁর হাতে ‘ফ্লাওয়ার ফেয়ারিজ’ ট্যাটু আঁকিয়েছেন। ডিজিটাল চটুল বিনোদনের জায়গা টিকটকের ‘ফেয়ারিকোর’ ট্রেন্ড আরো পরিচিত করে তুলছে খামখেয়ালি অথচ নান্দনিক ফুলেল এ নকশাকে।

সিসেলি বার্কারের সূক্ষ্ম জলরঙের কাজগুলো পরির বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্যকে জনপ্রিয় করতে সাহায্য করেছিল। পশ্চিমা বিশ্বে সেগুলোই এখন ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত হয়। তারা দেখতে ছোট্ট, মিষ্টি ও তারুণ্যে ভরা। জড়িয়ে থাকে গাছ, লতাপাতাসহ প্রকৃতির সঙ্গে। লেডি লিভার গ্যালারির প্রদর্শনীর কিউরেটর ফিওনা স্লেটারি ক্লার্ক অবশ্য মনে করেন, সিসেলি বার্কারের ছবি একই সঙ্গে ছিল শক্তভাবে বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে। শিশু চরিত্রগুলোর সবই আঁকা হয়েছিল বাস্তব জীবন থেকে। গাছপালা ও ফুল হতো যতটা সম্ভব বাস্তবসম্মত। বার্কারের এক বোনের বাড়ি ছিল লন্ডনের কাছেই ক্রয়ডনে। সে বাড়িতে নার্সারি স্কুল চালাতেন তিনি। ওই স্কুলের বাচ্চাদের মডেল করতেন বার্কার। তাঁর ছবির গাছ বা ফুলগুলোও ছিল উদ্ভিদ তত্ত্বের দিক থেকে নির্ভুল। হবেই না বা কেন, খোদ কিউ গার্ডেন নামে পরিচিত লন্ডনের বিখ্যাত বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে যে নমুনা সংগ্রহ করতেন তিনি!

ফ্লাওয়ার ফেয়ারিজ ছবির বই বাজারে যাওয়া মাত্রই হিট হয়। তবে সিসেলি বার্কার ফেয়ারি এঁকে সফল হওয়া তাঁর যুগের একমাত্র শিল্পী নন। সত্যি বলতে, যুক্তরাজ্যে আগের ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে চলেছিল পরি হুজুগ বা ‘ফেয়ারি ফিভার’। ১৯২৩ সালে বার্কারের ‘ফ্লাওয়ার ফেয়ারি’ আবির্ভাব হওয়ার মধ্য দিয়ে তা যেন তুঙ্গে পৌঁছেছিল। ১৯২০ থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যে পরিদের নিয়ে ৩৫০টিরও বেশি বই প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে ছিল এনিড ব্লাইটনের প্রথম পরিবিষয়ক বইও-১৯২৩ সালেই প্রকাশিত কবিতা সংকলন ‘রিয়েল ফেয়ারিজ’। ফেয়ারি-বিষয়ক শিল্প রাজকীয় অনুমোদন পর্যন্ত পেয়েছিল। রানি মেরি ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার শিশুতোষ বইয়ের অঙ্গসজ্জাকর শিল্পী আইডা রেন্টুল আউথওয়েটের আঁকা ছবির মহাভক্ত। পোস্টকার্ড আকারে সেসব ছবি পাঠিয়ে তা জনপ্রিয় করতে ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি।

পরিরা অন্তত কল্পনায় আমাদের সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরেই আছে। বিশ্বের সব সমাজের চিত্রটাই এক। কিন্তু আর্ট কিউরেটর আর ইতিহাসবিদ অ্যালিস সেজ জানালেন ইতিহাস সব সময় এমন ছিল না। ইউরোপীয় সমাজের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘অতীতে শত হাজার বছর ধরে পরিরা কিন্তু নেহাত খুদে বা নিরীহ বিবেচিত হয়নি। বরং তাদের মনে করা হতো রীতিমতো বিদ্বেষে ভরা, ভয়ংকর এক শক্তি, যারা অন্ধকার ঘনিয়ে আনতে পারে। ১৮০০ সালে আপনি নিজের সন্তানকে পরি বলে মনে করলে তা শয়তানের আসরের মতোই মনে করা হতো। সেই পরিকে তাড়ানোর জন্য বাচ্চাকে আগুনে ফেলে দিতেন আপনি।’

তবে ১০০ বছরের মধ্যেই পরিদের সম্পর্কে ব্রিটিশ সমাজের ধারণা সম্পূর্ণ বদলে যায়। ১৯ শতকজুড়ে ছবিতে (এবং মানুষের ভাবনায়) পরিদের আকার ক্রমে ছোট হয়ে ওঠে, তাদের ক্ষমতাও কমে যায়, তারা আটকা পড়ে শিশুদের নার্সারির চার দেয়ালে।

ইতিহাসবিদ অ্যালিস সেজ বলেন, ব্রিটেনে ভিক্টোরিয়ান যুগ এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিরা ক্রমে শৈশবের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আকারও হয়ে পড়ে সংকুচিত। তবে পরিরা ভিক্টোরিয়ান যুগের শিল্পীদের জন্য ক্রমে বেশ পছন্দের বিষয় হয়ে ওঠে। সূত্র : বিবিসি

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.