গুলি-বোমা, শীত-বর্ষা ক্ষুধায় দিশেহারা গাজা

আমি যখন এখানে এসেছিলাম বৃষ্টি মাত্র শুরু হয়ছিল। বাচ্চাটা তখনো আমার পেটে। আমি এবং আমার স্বামী বৃষ্টি থেকে বাঁচার ঠাঁই খুঁজছিলাম। কেননা, বৃষ্টির পানি প্রায়ই তাঁবুতে ঢুকে যায়। আগেও অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। তবে এমন দিন কখনো আসেনি- নিজের নবজাতককে কোলে নিয়ে অসহায়ভাবে বলছিলেন মধ্য গাজার দেইর-আল-বালাহ শহরের বাস্তচ্যুত ইসরা কামাল আল জামালান (২৮)।

বুলেট-বোমায় বিধ্বস্ত গাজায় এখন তাদের নতুন চ্যালেঞ্জ শীত ও বর্ষা। দিনে যেমন তেমন, রাত নামলেই জেঁকে বসে কনকনে শীত। হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় ঠক ঠক করে কাঁপে শরীর। অথচ গরম কাপড় নেই! আর ক্ষুধায় জ্বালা তো আছেই- সবমিলিয়ে নিঃস্ব গাজাবাসী রীতিমতো দিশেহারা। আলজাজিরা, এএফপি, বিবিসি, আরব নিউজ, সিএনএন, ওয়াফা।

ইসরাইলি তাণ্ডবে সুখের দিনগুলো থেকে ছিটকে পড়া গাজাবাসী এখন প্রকৃতির নির্দয়তার শিকার। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে, ভারি বৃষ্টিপাত ও তীব্র শীত যেন একসঙ্গে আছড়ে পড়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার প্রতিটি অঞ্চলে। ঘরবাড়ি ছেড়ে আসা বাস্তুচ্যুতরা অসহনীয় পরিস্থিতিতে দিনযাপন করছে।

এমনিতেই ফাঁকা মাঠ, ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী বালুভূমি, বিধ্বস্ত জনপদ, ফুটপাত বা জাতিসংঘের শরণার্থী শিবিরগুলোতে প্লাস্টিকের তাঁবু খাঁটিয়ে থাকতে হচ্ছে গাজাবাসীকে। বৃষ্টি শুরুর পর থেকেই সেই পলিথিনের ফুটো চুইয়ে পানি ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে। ভিজে যাচ্ছে মেঝে। তার ওপর আবার নতুন উপদ্রব শীত।

ভিটে-বাড়ি ছেড়ে আসার সময় শুধু গুটিকয়েক কাপড় নিয়েই পালিয়েছে অনেকে। ভেবেছিল সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সে আশার গুঁড়ে বালি। প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রের অভাবে এখন অতিকষ্টে সময় পার করতে হচ্ছে। ‘মুরগির খোপের মতো’ ছোট্ট জায়গায় গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে একটা পুরো পরিবারকে! রাতে হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় নিজেদের গরম রাখতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে পরিবারের সদস্যরা। অনেকে আবার গাছ কেটে আগুন জ্বালিয়ে গরম রাখছে নিজেদের।

অস্থায়ী ক্যাম্পে অবস্থান করা ইসরা কামাল জানান, ঠান্ডায় তার নবজাতক মেয়েটির ত্বক ফ্যাকাশে ও হলুদ হয়ে গেছে। গরম পোশাক ও কম্বল ছাড়া বাচ্চাটিকে তাঁবুর ভেতর রাখতে হিমশিম খাচ্ছে তারা। শ্বাসকষ্টজনিত কারণে তাকে বাইরে আগুনের সামনেও নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না! কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘সে (কাঠের ধোঁয়া থেকে) কাশি দিতে থাকে যতক্ষণ না সে নীল হয়ে যায়। আমরা আতঙ্কিত ছিলাম যে সে মারা যেতে পারে। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত। তাকে এখনো টিকা দেওয়া হয়নি। ’হাসপাতালে থাকাকালীন ইসরা দম্পতিকে একটি শীতবস্ত্র দিয়েছেন একজন দয়ালু ব্যক্তি।

ধীরকণ্ঠে ইসরা কামাল বলেন, ‘জন্মের পর থেকে সেটিই গায়ে দিচ্ছে আমার ছোট্ট সোনামণি। যখন সে জামাটি ছুড়ে ফেলে, আমি এটি মুছে দেই, কারণ আবহাওয়া ঠান্ডা থাকায় আমি এটি ধুয়ে ফেলতে পারি না।’ হতাশা নিয়ে তার স্বামী সেলিম বলেন, ‘আমি ভাবিনি আমার মেয়ে এমন অবস্থায় জন্ম নেবে। আমরা তার জন্মের জন্য খুব খুশি এবং প্রস্তুত ছিলাম। আমি জানি না আমাদের, সবার কী হবে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবার সহায় হোন।’

ইতোমধ্যেই গাজায় গরম কাপড়, কম্বল, শুকনো খাবার এবং তাঁবু বাধার সরঞ্জাম দিয়েছে জাতিসংঘ। তবে ঠান্ডার ভয়াবহতা এখনো পুরোপুরি হয়নি বলেও জানিয়েছে জাতিসংঘের ত্রাণ ও পুনর্বাসন সংস্থার (ইউএনআরডব্লউএ) ডিরেক্টর থমাস হোয়াইট। তিনি বলেন, ‘মানুষ একেবারেই শোচনীয় পরিস্থিতিতে বাস করছে। তবে আমি বলব শীতের ভয়াবহতা এখনো আসেনি। আমরা এখনো তাপমাত্রায় বড় পতন দেখিনি। এখন পর্যন্ত একটি বড় ঝড়ও দেখিনি ভ‚মধ্যসাগরে।

যখন ভূমধ্যসাগরে বড় ঝড় সৃষ্টি হবে, তখন অনেক আশ্রয়কেন্দ্র তছনছ হয়ে যাবে। ত হাজার হাজার মানুষকে ভিজে, ঠান্ডায় ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকতে হবে।’ চলমান এই বেগতিক আবহাওয়ার মধ্যেই গাজায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ খাদ্য সংকট।

স্থানীয় বেকারি এবং খাদ্যগুদামগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সমস্যা আরও বেড়ে গিয়েছে। গাজার ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) রিপোর্ট অনুসারে, গাজার ২.৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। তাদের তথ্যমতে, ডিসেম্বর শুরুর পর থেকে ২০ লাখ গাজাবাসী খাবারের তীব্র সংকটে পড়েছে। এদের মধ্যে ৩ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ ‘সর্বনাশা ক্ষুধায়’ দিন-রাত পার করছে। একটুকু খাবারের আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কেউ কেউ। তবুও খাবার পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে অবস্থিত একটি মানবাধিকার সংস্থা আল মেজানের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রের কাছাকাছি লোকেদের প্রায়ই ১০ ঘণ্টা লাইনে অপেক্ষা করতে হয় এবং মাঝে মাঝে খালি হাতে বাড়ি ফিরে। এমনকি বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের ৫ জনের মধ্যে ৪ জনই গাজায়।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতারেস। শনিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে পোস্ট করে তিনি লিখেন, ‘বিশ্বের ৫ জন ক্ষুধার্তের ৪ জনই এখন গাজায়। গাজায় সংঘাতের তীব্রতা ও ভয় যতই বাড়ুক না কেন আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাব। আত্মসমর্পণ করব না।’

গাজা উপত্যকায় নিয়মিত খাবার তৈরির কাজ করেন বাকের আল-নাজি (২৮)। কিন্তু তার মন ভেঙে যায় তখনই, যখন তিনি দেখতে পান তার তৈরি খাবার অভুক্ত শিশুদের ক্ষুধা মেটাতে পারছে না। গাজার দক্ষিণাঞ্চলে স্বেচ্ছায় রান্নার কাজ করা নাজি বলেন, ‘আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত হলো হাতে হাতে খাবার বিতরণের সময়টি। আমার বুকে খুব যন্ত্রণা হয় যখন খাবার শেষ হয়ে যায়, আর শিশুরা বলতে থাকে তাদের পেট ভরেনি।’ এই অবস্থায় বেশিরভাগ স্বেচ্ছাসেবীই তাদের নিজেদের খাবারগুলো শিশুদের দিয়ে দেয়। যুদ্ধের দুই মাস ধরে, মাত্র ১,২৪৯টি ট্রাক খাদ্য সহায়তা বহনকারী গাজায় পৌঁছেছে। বিশ্বখাদ্যসংস্থার ৬ ডিসেম্বরের রিপোর্টে এ তথ্য জানা যায়। ক্ষুধা এবং ঠান্ডায় নানান ধরনের অসুস্থতা দেখা যাচ্ছে গাজায়।

প্রায় ১ লাখ মানুষের ডায়রিয়ার সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাদের মধ্যে অর্ধেকই ৫ বছরের নিচে। পাশপাশি ফুসফুসে ইনফেকশনে ভুগছেন প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ। তবে বেশিরভাগ মানুষই মস্তিষ্কের প্রদাহ, র‌্যাশ, স্কার্ভি, চিকেনপকম, হেপাটাইটিসসহ নানান স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। ভয়াবহ পরিস্থিতি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতারক্ষেত্রেও। গড়ে ২২০ জনে প্রতি একজন টয়লেট সুবিধা ভোগ করতে পারছে। অন্যদিকে গড়ে ৪৫০০ জনে মাত্র ১ জন গোসলের সুযোগ পাচ্ছে।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.