কি পেলো ভারত?

সফর শুরুর আগে আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে যে সুরে বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সোমবার আমদাবাদের মাটিতে পা ছুঁইয়ে সেই সুর বদলে ফেললেন তিনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভূয়সী প্রশংসা করলেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের এগিয়ে যাওয়ার ছবিও তুলে ধরলেন। বোঝালেন প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ব্যক্তিগত রসায়ন এখন কোন পর্যায়ে। এ-ও বোঝালেন ভারত কতটা নেক নজরে রয়েছে আমেরিকার।

মোতেরার সর্দার বল্লভভাই পটেল স্টেডিয়ামে এ দিন তাঁর ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বার বার প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদীর বিশ্বস্ত বন্ধু। ভারতেরও অত্যন্ত বিশ্বস্ত। ধর্মীয় স্বাধীনতার মতো কোনও বিতর্কিত প্রসঙ্গ তো তুললেনই না, বরং ভারতের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, নাগরিকদের অবাধ স্বাধীনতাকে দরাজ গলায় স্বীকৃতি দিলেন।

একই ভাবে অতিথি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পেরও ভূয়সী প্রশংসা করলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ফেলে এ দিন দুই রাষ্ট্রনেতার ব্যক্তিগত রসায়নের একটি নজরকাড়া প্রদর্শন হল বলা যায়। যা অদূর ভবিষ্যতে দু’দেশের সম্পর্ককে উঁচু তারে বাঁধতে পারে। অন্তত সেই সম্ভাবনাটা শুধুই জিইয়ে থাকল না, বলা যায় জোরাল করে দিল। কিন্তু দু’টি দেশের মধ্যে স্বার্থের বোঝাপড়া না থাকলে, দু’টি শক্তিশালী রাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার না হলে, শুধুই ব্যক্তিকেন্দ্রিক কূটনীতি দিয়ে এগিয়ে চলা মুশকিল।

ট্রাম্প ও মোদী দু’জনেই এত দিন যেটা সফল ভাবে বোঝাতে পেরেছেন, এ দিনও সেটাই বোঝালেন। তাঁরা দু’জনেই সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করতে পারেন। টুইটারে দু’জনেই প্রায় সমান জনপ্রিয়। ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তার মিশেলে দুই রাষ্ট্রনেতাই এমন একটা ইমেজ তৈরি করেছেন যা তাঁদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উচ্চাশাকে বাস্তবায়িত করার সহায়ক।

এ দিন মোদী এবং ট্রাম্প যে ভাবে একে অন্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এটা পরিকল্পিত ভাবেই করা হয়েছে। ট্রাম্প বার বার চেষ্টা করেছেন, নিজেকে মোদী এবং ভারতের বিশ্বস্ত বন্ধু হিসাবে প্রতিপন্ন করার। সফর শুরুর আগে, আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে ‘ভারতের কাছ থেকে ভাল ব্যবহার পাইনি’ বলে মন্তব্য করেছিলেন ট্রাম্প।

ভারতে এসে অবশ্য সেই পথে পা বাড়ানো তো দূরের কথা, ভারতের বিকাশকে তিনি একটি অভিনবত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। বোঝাতে চেয়েছেন, অর্থনীতি, রাজনীতি, বিদেশনীতি ও প্রতিরক্ষা নীতিতে ভারত যে ভাবে উঠে এসেছে তা একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। ট্রাম্প বলেছেন, ভারতের বিকাশ সম্ভব হয়েছে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পথ ধরে। যা একটি দৃষ্টান্ত। এর মাধ্যমে পরোক্ষে চিনকে বার্তা দিয়েছেন, কঠোর দমন পীড়নের মাধ্যমে কোনও দেশের বিকাশ মর্যাদাজনক হতে পারে না।

দু’দেশের সম্পর্ককে জোরদার করার লক্ষে কোনও বিতর্কিত প্রসঙ্গে এ দিন যাননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ভারতের পূর্ব দিকে যে ইন্দো-প্যাসিফিক দেশগুলি আছে (জাপান, অস্ট্রেলিয়া), তাদের সম্পর্কে মার্কিন বিদেশনীতির সঙ্গে ভারতের বিদেশনীতির বিশেষ বিরোধ নেই। ওই দুটি দেশ যেমন আমেরিকার বন্ধু, তেমন ভারতেরও বন্ধু। কিন্তু ভারতের পশ্চিমে যে দেশগুলি রয়েছে (আফগানিস্তান, ইরান এবং পাকিস্তান), সেই দেশগুলি সম্পর্কে ভারত ও আমেরিকার স্বার্থ এবং বিদেশনীতির মধ্যে দৃশ্যতই কিছু বিরোধ রয়েছে। কিন্তু সেই প্রসঙ্গগুলি মোটামুটি ভাবে এ দিন এড়িয়ে গিয়েছেন দুই রাষ্ট্রনেতা। বরং ভারতের পক্ষে যা উৎসাহজনক হতে পারে, সন্ত্রাসবাদের দমনে সেই বার্তাই দিয়েছেন পাকিস্তানকে। আবার এ-ও বলেছেন ট্রাম্প, যে পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক আগের চেয়ে ভাল হয়েছে। আফগানিস্তানের তালিবানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করতে চলেছে ট্রাম্প প্রশাসন। আর সেই তালিবানদের সঙ্গে যথেষ্টই সুম্পর্ক ইসলামাবাদের। তাই পাকিস্তানকেও এখন প্রয়োজন ট্রাম্পের। কিন্তু সেটা ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প খুব জোর গলায় বলেননি।

এই সব কিছু থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে মোদীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের রসায়নকে গুরুত্ব দিতে চাইছেন ট্রাম্প। ব্যক্তিকেন্দ্রিক কূটনীতির মাধ্যমে চাইছেন আগামী দিনে ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে আরও জোরদার করে তুলতে। তবে তার জন্য প্রয়োজন বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কের মতো দু’টি শক্তিশালী ভিত। বড় অঙ্কের প্রতিরক্ষা চুক্তি এ বারই হতে চলেছে। আগামী দিনে বাণিজ্যিক চুক্তির পথটাও এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক কূটনীতির রাস্তা ধরেই খুলে রাখতে চান, বোঝালেন ট্রাম্প ও মোদী দু’জনেই।

একে অন্যের প্রয়োজন বোঝে ৩০ বছর আগে

সহজ কথায়, ভারতের বিশাল বাজারে আরও বেশি পণ্য রফতানি আর পুঁজির অনুপ্রবেশে‌র যেমন লাভজনক দিক রয়েছে, তেমনই বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির দাবার চালে আগামী দিনের জোট গড়ে তোলার জন্য ভারতকে পাশে পেতে চায় আমেরিকা।

অন্য দিকে, ভারতের কাছে আমেরিকার সহযোগিতা আন্তর্জাতিক স্তরে তার সুরক্ষা এবং ক্ষমতা-বৃদ্ধির সহায়ক। আমেরিকার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন-ঘনিষ্ঠ দেশগুলিও ভারত সম্পর্কে উৎসাহী। তাই দু’টি দেশের পরস্পরের কাছাকাছি আসার যথেষ্টই কারণ রয়েছে। যা এই দুই দেশের সমসাময়িক দুই নেতার ব্যক্তিগত রসায়নের চেয়েও বেশি প্রভাবশালী।

বিশ্বের সবক’টি প্রধান দেশের সঙ্গেই এখন কুশলী অংশীদারির (‘স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’) নীতি নিয়ে চলছে ভারত। আমেরিকার সঙ্গে এই স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ অবশ্য কয়েক কদম এগিয়ে। যার মধ্যে পড়ে অসামরিক পারমাণবিক ক্ষেত্র, মহাকাশ ও উচ্চ প্রযুক্তির লেনদেন, ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলা ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত বিষয়।

চমকপ্রদ কোনও সমঝোতা হবে কি?

আমেরিকায় ‘হাউডি মোদী’ অনুষ্ঠানে ট্রাম্প নিজেকে ভারতের ‘সর্বকালের সেরা বন্ধু’ বলে দাবি করেছেন। ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। মার্কিন মুলুকে আসন্ন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্নির্বাচিত হতে প্রবাসী ভারতীয়দের উপর নজর ছিল ট্রাম্পের। তাই ভারত-বন্ধু হিসাবে একটা ইমেজ গড়ে তুলতে তিনি সচেষ্ট।

সমঝোতার যে ক্ষেত্রগুলি খোলা থাকছে

তবুও কুশলী অংশীদারির পথে হেঁটেই আলোচনার ও সমঝোতার বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র খোলা থাকছে। ২০০৪ সালে ঘোষিত ‘নেক্সট স্টেপ্‌স ইন স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ (এনএসএসপি)’ আগেই উল্লিখিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সহযোগিতার রূপরখা তৈরি করে দিয়েছে। সম্পর্কের চড়াই-উতরাই থাকলেও, ভারত-মার্কিন সম্পর্ক প্রত্যাশিত পথেই ক্রমবর্ধমান। সেই দিক থেকে কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের গুরুত্ব রয়েছে।

মঙ্গলবার কয়েকটি সমঝোতাপত্র (‘মেমোরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ বা ‘মউ’) স্বাক্ষরিত হবে, যা এনএসএসপি-র সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই হওয়া সম্ভব। তাই প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি মাল্টি-রোল হেলিকপ্টার কিনতে চলেছে ভারত। পরমাণু চুল্লি সরবরাহ মারফত অন্ধ্রপ্রদেশে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পথ খুলতে পারে। বাড়তে পারে মহাকাশ গবেষণার যৌথ পরিসর, সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান। স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত বিষয়, বিশেষ করে, ভারতের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি এবং জেনেরিক মেডিসিন মার্কিন বাজারে পৌঁছে দেওয়া, মনোরোগ সংক্রান্ত গবেষণাও মোদী ও ট্রাম্পের আলোচনার বিষয় হতে পারে।

ট্রাম্পের বিশ্বস্ত বন্ধু হতে কিছু শুল্ক কমাতে পারেন মোদী

শুল্ক কমিয়ে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির বড়াই চালিয়ে যেতে পারেন মোদী। ভারতীয় পণ্যাদির উপর আমেরিকা শুল্কের বোঝা চাপানোর প্রত্যুত্তরে ভারতও মার্কিন পণ্যাদির উপর শুল্কের বোঝা চাপিয়েছে। এই শুল্ক-লড়াইয়ে প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে মার্কিন সংস্থা ‘হার্লে ডেভিডসন’-এর বানানো মোটরসাইকেলের উপর চাপানো কর। এই কর কমানো হলে তা একটা সদর্থক বার্তা পৌঁছে দেবে এবং সে ক্ষেত্রে ভাবী বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে সদিচ্ছার আভাসও পাওয়া যেতে পারে।

আবার মোদী এবং ট্রাম্প, দু’জনেই যেহেতু প্রথা-বহির্ভূত চমক দিতে সিদ্ধহস্ত, তাই এই সফরে অপ্রত্যাশিত কোনও ঘোষণাও শোনা যেতে পারে।

এ ছাড়াও, আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও বেশি পরিমাণে ভারত-মার্কিন বোঝাপড়া জরুরি। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নৌযান চলাচলের স্বাধীনতার বিষয়ে ভারত ও আমেরিকার ধারণা মোটামুটি এক। ভারত-মার্কিন সম্পর্ক এখন যে চেহারা নিয়েছে, তা দু’টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে স্বাভাবিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক। তাতে আশা আছে, হতাশা রয়েছে। সহযোগিতা আছে, আবার নিজের নিজের স্বার্থ নিয়ে লড়াইও আছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সফর এ সম্পর্কে একটা মোহরের ছাপ মাত্র!

লেখক,
অধ্যাপক অনিন্দ্যজ্যোতি মজুমদার।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়,
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.