স্বাস্থ্য তথ্য নিয়ে ডেটাবেজ তৈরি, স্বাস্থ্য খাতে পৃথক ক্যাডার সার্ভিস চালু সময়ের দাবি

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের ওয়েবিনারে বক্তারা

দেশের স্বাস্থ্যখাতের সমস্যাগুলো দূর করতে প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা। পাশাপাশি নাগরিকদেরও হতে হবে স্বাস্থ্য সচেতন। স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগ বরাবরই কম ছিল। এক্ষেত্রে শুধু বিনিয়োগ করলেই হবেনা সেই সাথে প্রয়োজন সুশাসন ও আইনের কঠোর প্রয়োগ। সবার জন্য সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সকলের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে একটি ডেটাবেজ তৈরি করা। স্বাস্থ্য খাতে পৃথক ক্যাডার সার্ভিস চালু করা এখন সময়ের দাবি।

গত রাতে (১৫ নভেম্বর) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় আইনের সীমাবদ্ধতা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে আলোচকরা এসব মতামত দেন। ওয়েবিনারটিতে আলোচক হিসেবে অংশ নেন ইংল্যান্ড থেকে সমাজবিজ্ঞানী ড. তানভীর আহমেদ পিএইচডি, কানাডা থেকে জাতিসংঘের ক্যাপিটাল ডেভেলপমেন্টে কর্মরত তরুণ অর্থনীতিবিদ গালিব ইবনে আনোয়ারুল আজিম এবং বাংলাদেশ থেকে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আইনজীবী এবং গণস্বাস্থ্য গবেষক লুবনা ইয়াসমিন।

শুরুতেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামকে এই অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ড. তানভীর বলেন, বাংলাদেশে সবার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে, এটা নাগরিক অধিকার এবং তা করতে পারে একমাত্র রাষ্ট্র। স্বাধীনতার পর হতে অদ্যাবধি স্বাস্থ্যসেবা খাতে দেশের অনেক অর্জন এবং গর্বের জায়গা থাকলেও এ নিয়ে সংগ্রাম চলতেই থাকবে যতক্ষণ না স্বাস্থ্যকে সাংবিধানিক অধিকারের মর্যাদা দেয়া হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা।

দেশের স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগ বরাবরই কম ছিল উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ গালিব বলেন, ধারাবাহিভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলেও প্রয়োজনের জায়গায় এখনও পৌঁছাতে পারেনি। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিগত দুই দশকে ধোয়াশা ছিল, সরকারে যারাই ছিলেন তাদের মধ্যে দ্বিধা ছিল কতটুকু সরকার করবে আর কতটুকু বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হবে। সেই সাথে বহির্মুখী স্বাস্থ্য অর্থনীতি তৈরি হয়েছে, বহু রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। করোনা বিধিনিষেধের কারণে অনেকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মতো দেশে না যেতে পেরে এখন তুরস্ক, দুবাই যাচ্ছেন৷

স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির রূপ তুলে ধরে তিনি বলেন, শুধু বিনিয়োগ করলেই হবেনা সেই সাথে প্রয়োজন সুশাসন ও আইনের কঠোর প্রয়োগ। তাছাড়া শুধু বিত্তবানেরাই কি ভালো বেসরকারি হাসপাতাল বা বিদেশে গিয়ে সুচিকিৎসা নিতে পারবে নাকি সব শ্রেণীর মানুষের সুচিকিৎসার জন্য সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যখাতের সুসমন্বয় করা হবে সে সিদ্ধান্তও নিতে হবে। দেশের সব মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কথা দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় ভাবা যেতেই পারে।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম অনেক সুন্দর এবং প্রয়োজনীয় একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করছে মন্তব্য করে ব্যারিস্টার শামীম অন্য দুই আলোচকের সাথে সম্পূর্ণ একাত্মতা পোষণ করেন। তিনি বলেন, আমাদের মূল সমস্যা মানসিকতায়। সারা পৃথিবীর মধ্যে যে চার দেশ স্বাস্থ্যখাতে জিডিপিতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয় তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এছাড়া যা দেয়া হয় তার মধ্যেও রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি। তাছাড়া স্বাস্থ্য-অর্থনীতিবিদদের বাজেট দেয়ার ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা রাখার সুযোগ দেয়া হয়না।

ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ এর আগে ইউনিভার্সেল হেলথ ড্যাটা প্রয়োজন বলেও তিনি মত দেন। দেশের সব মানুষের জন্য একটি হেলথ কার্ড থাকবে যেখানে প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের একেবারে মৌলিক জিনিসগুলো যেমন রক্তের গ্রুপ, ডায়াবেটিস আছে কিনা, প্রেশার রয়েছে কিনা এসব উল্লেখ থাকবে। এই হেলথ কার্ড দেখে চিকিৎসক রোগীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে সহজেই প্রাথমিক ধারণা লাভ করতে পারবেন। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালকে একটা প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। শুধু বিত্তবানেরাই সুচিকিৎসা পাবে আর দরিদ্ররা নিম্নমানের হাসপাতেলে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হবে, তা হতে পারে না। এছাড়া অনেক বেসরকারি হাসপাতালে চাকচিক্য থাকলেও সেগুলো মানসম্পন্ন নয়। চিকিৎসক যেখানেই রোগী দেখেন না কেন তার জন্য একটা ফি নির্ধারণ করে দিতে হবে, প্রয়োজনে সরকার তাকে অর্থ দেবে।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করলেই যে সব সমাধান হয়ে যাবে তা নয়। কারণ অনেক মৌলিক অধিকারই লংঘনের নজির রয়েছে। এখানে সরকারের সদিচ্ছাই মূল বিষয়। দেশে চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি যেমন করতে হবে তেমনি ভবিষ্যতে রোগীর সংখ্যা কমাতে হবে। জনগণের সুস্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যসচেতনতা নিশ্চিতে সব এলাকায় সরকারি সহযোগিতায় খেলার মাঠ, ব্যয়ামাগার প্রস্তুত করতে হবে। ১৮ কোটি মানুষের জন্য শুধু আধুনিক স্বাস্থ্যসেবায় নির্ভর না থেকে যোগব্যায়াম, আয়ুর্বেদ এসবের দিকেও ঝুঁকতে হবে।

টেলিমেডিসিন বা ভিডিওকলে চিকিৎসা সেবা দেয়ার উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, সরকার জোর গলায় এসব নিয়ে সাফল্যের কথা বললেও বাস্তবে সেরকম প্রভাব ফেলেনি। বিশেষ করে, চরাঞ্চল বা পাহাড়ি এলাকায়। বিদেশ থেকে চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার নামে সরকারি বিপুল অর্থ লুটপাট করা হয়৷ বাংলাদেশ ডক্টর সার্ভিস বা মেডিক্যাল সার্ভিস নামে পৃথক ক্যাডার সার্ভিস চালু করা এখন সময়ের দাবি। করোনাকালে শুরু থেকে চিকিৎসকদের কথা শুনলে অনেক মানুষকে হারাতে হতো না। সব কিছু মিলিয়ে স্বাস্থ্যখাতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে নতুন আইন করার চেয়েও জরুরি সরকারের সদিচ্ছা। প্রত্যেক এমপির উচিত স্বাস্থ্যখাত নিয়ে ভাবা, অবৈধ প্রভাব বিস্তারকারী সিন্ডিকেট ভেংগে ফেলা।

রেফারেল সিস্টেম প্রসংগে বলতে গিয়ে ড. তানভীরও ব্যারিস্টার শামীমের মতো একটি ড্যাটাবেজ তৈরির উপর জোর দেন যেখানে প্রোভাইডার, কমিউনিটি সহ সংশ্লিষ্ট সবার ড্যাটা থাকবে। তিনি বলেন, রেফারেল সিস্টেম বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.