দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রবাসীদের ভূমিকা

ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল

বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে উন্নতি লাভ করছে। দেশের জিডিপি বাড়ার ফলে মাথাপিছু আয় বেড়েছে এবং জীবযাত্রার মান আগের তুলনায় উন্নত হচ্ছে। যদিও করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত কয়েক বছরে অর্থনীতির গতি কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তবে এই প্রতিবন্ধকতা শিগিগরই আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব বলে আশা করি।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা পালন করছে পোশাকশিল্পের বিকাশ ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি। ২০২০ সালে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা সেই সময়ের জিডিপির ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রাপ্ত মোট প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লাখ ৩৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০২২ সালে দেশে পাওয়া প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ২০২১ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম প্রবাসী আয় অর্জনকারী দেশ ছিল। বাংলাদেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং আমেরিকা, কুয়েত, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশ থেকে সর্বাধিক প্রবাসী আয় পেয়ে থাকে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও আমেরিকার কাছ থেকে প্রবাসী আয় পেয়েছে যথাক্রমে ৪২ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা, ২৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং ২৫ হাজার ৪ শত ৭৬ কোটি টাকা। এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে পাওয়া মোট প্রবাসী আয়ের ১৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ ব্যয় হয় জমি কেনায়, ৩৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ ব্যবহৃত হয় বিনিয়োগে এবং সঞ্চয় হয় ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ। ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরবে বসবাস করেন প্রায় ২৫ হাজার প্রবাসী, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১২ লাখ এবং যুক্তরাজ্যে এর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। ২০২২ সালের অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে দেশে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ২৫০ কোটি টাকা প্রবাসী আয় এসেছে আমেরিকা থেকে এবং সৌদি আরব থেকে এসেছে প্রায় ৯ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। আমেরিকায় অবস্থানরত বাংলাদেশি প্রবাসীদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার ফলে আমেরিকা থেকে প্রচুর পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক যাচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রায় ৫ কোটি জনগণ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে। ২০১৯ সালে দেশ থেকে প্রায় ৭ লাখ শ্রমিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। ২০২১ সালে এর সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ লাখ ৪০ হাজার। বিভিন্ন দেশে গমনকারী শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ অদক্ষ শ্রেণির। এ দুই বছরের বিদেশ গমনকারী শ্রমিকের ৯০ শতাংশের চেয়ে বেশি গমন করেছেন সৌদি আরব এবং ওমানে। বিদেশে গমনকারী অদক্ষ শ্রমিকের মধ্যে বেশির ভাগই কুমিল্লা ও বাহ্মণবাড়িয়া জেলার অধিবাসী।

বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সৌদি আরব, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ও মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশের প্রবাসীদের অধিকাংশই অদক্ষ শ্রমিক শ্রেণির। তাদের কষ্টার্জিত অর্থ প্রধানত খরচ হচ্ছে পারিবারিক ব্যয় নির্বাহে। তাদের পাঠানো অর্থে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশ লাভ করছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কিছুদিন আগে সুযোগ হয়েছিল সিলেট জেলার কানাইঘাটের গাছবাড়ী বাজারে যাওয়ার। আশ্চর্য হলাম এবং দেখলাম, যে বাজারে ১৫-২০ বছর আগে উল্লেখ করার মতো খুব একটা কিছু ছিল না, বর্তমানে সেই বাজারে এসি, ফ্রিজ, মোবাইল ফোনসেট ইত্যাদি সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। বড় ধরনের মিষ্টির দোকান, কনফেকশনারি ইত্যাদিতে বিদেশি প্রসাধনী সামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের বিলাসী পণ্য বিক্রি হচ্ছে। প্রবাসীদের মাধ্যমে পাঠানো অর্থে গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্র পালটে যাচ্ছে। বিলাসী পণ্য ব্যবহারের চাহিদাও বাড়ছে এবং বাড়ছে জীবনযাত্রার মান।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি রয়েছেন। দেশে বৃহত্ বিনিয়োগ করতে আর্থিকভাবে সক্ষম এমন প্রবাসীরা এসব দেশে বাসবাস করেন। ইংল্যান্ড, আমেরিকা ইত্যাদি দেশে বসবাসরত বাংলাদেশি, যারা দীর্ঘদিন ধরে সেই সব দেশে অবস্থান করছেন, তাদের অনেকেই বাংলাদেশে থাকা তাদের সম্পত্তিসমূহ ইতিমধ্যে বিক্রি করে ফেলেছেন অথবা বিক্রির আগ্রহ প্রকাশ করছেন। এর ফলে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে এবং এতে দেশে প্রবাসী আয় হ্রাস পেতে পারে। কথা হলো স্কুলজীবনের সহপাঠী এবং ইংল্যান্ডের স্টাফোর্ডশায়ার ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. শহীদুল হাসান বাপ্পীর সঙ্গে, যিনি ইতিপূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তিনি জানালেন, চাকরিজীবী এবং অন্যান্য কাজে নিয়োজিত বাংলাদেশি প্রবাসীরা দেশে সম্পত্তি কেনার চেয়ে ইংল্যান্ডে সম্পত্তি কিনতে আগ্রহী বেশি। বাংলাদেশে বিশ্বস্ত ব্যক্তির অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনা ইত্যাদির কারণে দেশে অর্থ বিনিয়োগে চাকরিজীবীরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। প্রক্ষান্তরে, ব্যাবসায়িক মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অনেকে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সিলেট শহরের রোজ ভিউ হোটেল, গ্রান্ড সিলেট হোটেল, হবিগঞ্জের বাহুবলে অবস্থিত দ্য প্যালেস রিসোর্ট, সিলেটের বারাকা পাওয়ার লিমিটেড কোম্পানি, বিভিন্ন রিসোর্ট, শপিং মল, বিভিন্ন হাসপাতাল ইত্যাদিতে ইংল্যান্ডে অবস্থানরত প্রবাসীদের প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে অবস্থানরত ধনাঢ্য শ্রেণির ব্যক্তিদের দেশে বিনোয়োগে আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং দেশের ভাবমূর্তি বাড়ানোর বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত।

দেশে অবস্থানরত সম্ভাব্য সক্ষম উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন ব্যাবসায়িক উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রবাসীদের বিনিয়োগে আগ্রহী করা একান্ত প্রয়োজন। এতে দেশের সঙ্গে প্রবাসীদের এবং প্রবাসীদের পরবর্তী প্রজন্মের সম্পর্ক বাড়বে। প্রবাসীদের মাধ্যমে পাঠানো অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চন্ত করা প্রয়োজন। অপ্রয়োজনীয় ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় সংকোচন করা দরকার। প্রবাসীদের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকসংক্রান্ত সমস্যা, বিশ্বস্ত ব্যক্তির অভাব এবং ব্যাবসায়িক ঝুঁকি গ্রহণের অনীহা একটি বড় সমস্যা। প্রবাসীদের বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগের খাতসমূহ শনাক্ত করা প্রয়োজন। বর্তমান প্রজন্মের অনেক প্রবাসী দেশে আসতে চাইলে অনেক ক্ষেত্রে অত্মীয়স্বজন ও পরিচিতদের কাছ থেকে তেমন উত্সাহ পান না। বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে প্রবাসীদের বিশাল অবদান রয়েছে।

প্রবাসীরা আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। প্রবাসীদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূরীকরণের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা এবং এর সঠিক বাস্তবায়ন প্রয়োজন। প্রবাসীদের ধন্যবাদ। কেননা, তাদের পাঠানো কষ্টার্জিত অর্থে সমাজ, শহরকেন্দ্রিক অর্থনীতি, গ্রামকেন্দ্রিক অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে। শুধু অর্থ পাঠানোই নয়, বরং আপনাদের সুচিন্তিত মতামত ও দিকনির্দেশনা আমাদের আত্মিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়নে একান্ত প্রয়োজন।

লেখক : অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.