‘স্বাস্থ্য আইনের অপ্রতুলতা স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবার অন্তরায়’
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের ওয়েবিনারে বক্তারা
দেশের স্বাস্থ্যখাতের অন্যতম সমস্যা সম্পদের অপ্রতুলতা এবং সর্বক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা। স্বাস্থ্য আইনের অপ্রতুলতাও স্বাভাবিক স্বাস্থ্য সেবার অন্তরায়। এছাড়া ফরেনসিক চিকিৎসকদের নিরাপত্তায় বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ অতীব জরুরি বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী, চিকিৎসক এবং গণমাধ্যমকর্মীরা। গতকাল রাতে (২৪ অক্টোবর) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় আইনের সীমাবদ্ধতা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে তারা এই মত জানান। এতে আলোচক হিসেবে অংশ নেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. সুমন নাজমুল হোসেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট অমি রহমান পিয়াল। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আইনজীবী এবং গণস্বাস্থ্য গবেষক লুবনা ইয়াসমিন।
শুরুতেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামকে এরকম একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ডা. সুমন বলেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে চিকিৎসকরা সেসকল সমস্যা মোকাবেলা করেন তার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে সম্পদের অপ্রতুলতা, আমাদের মতো মধ্য আয়ের দেশের জন্য যা স্বাভাবিক। এরপর রয়েছে ব্যবস্থাপনার সংকট। তাছাড়া ১৭ কোটি মানুষের দেশে যে ধরনের অবকাঠামো থাকা প্রয়োজন অনেক ক্ষেত্রেই তা নেই। কিছু ক্ষেত্রে ভালো থাকলেও সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে আছি। চতুর্থত, আইনের সীমাবদ্ধতা।
পিয়াল তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবায় মূল সমস্যা ব্যবস্থাপনায়। সব জায়গায় সমন্বয়হীনতার অভাব। করোনা মোকাবেলায় চিকিৎসকদের পিপিই না দিয়ে চিকিৎসাক্ষেত্রে পাঠানো, অস্ত্র না দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর মতো। এগুলো গুরুতর অপরাধ। সরকারি হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগের অবস্থা নাজুক। পর্যাপ্ত চিকিৎসা উপকরণ নেই, আবার অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির কারণে অপ্রয়োজনীয় উপকরণ সাজিয়ে রাখার মতো বিষয়ও আছে। এ থেকে উত্তরণে রোগীদের স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনার পাশাপাশি চিকিৎসক এবং হাসপাতালগুলোর জন্য একটা বিধিমালা থাকা জরুরি। গোটা স্বাস্থ্যখাতকেই ঢেলে সাজাতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আইন ঠিকই আছে, অভাবটা সমন্বয়ের।
ব্যারিস্টার রাশনা বলেন, সংবিধানে স্বাস্থ্যকে এখনো মৌলিক নাগরিক অধিকারের মর্যাদা দেয়া না হলেও, উচ্চ আদালত বারবার তার ব্যাখ্যায় একে মানুষের জীবনের যে মৌলিক অধিকার তাতে অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছেন। সংবিধানের ১৫তম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে নাগরিকদের মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করতে হবে যার মধ্যে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষার সাথে স্বাস্থ্যও রয়েছে; যা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির মধ্যে পড়ে। এর অর্থ এগুলোকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গেলে মাথায় রাখতেই হবে। অন্যদিকে ১৮তম অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছে, জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের কথা মাথায় রেখেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে।
তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট অনেক আইন থাকলেও মূলত দুটি আইন আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতকে নিয়ন্ত্রণ করছে। একটি হলো বাংলাদেশ মেডিক্যাল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন-২০১০ যা মেডিক্যাল এবং ডেন্টাল চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণ করছে। আর মেডিক্যাল প্র্যাকটিস এন্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস এন্ড ল্যাবরেটরিস রেগুলেশন্স অর্ডিন্যান্স-১৯৮৫ যা নিয়ন্ত্রণ করছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাবরেটরি ইত্যাদিকে। কিন্তু এসব আইনের অনেক অপর্যাপ্ততা এবং ফাঁকফোকড় রয়েছে যেগুলোতে সংশোধনী আনতেই হবে। আমাদের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কে সব ঠিক নেই, অনেক ঘাটতি রয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে আইনগত দুর্বলতার পাশাপাশি প্রায়োগিক দুর্বলতা যেমন মনিটরিংও নেই৷ আর তাই চিকিৎসক বা হাসপাতালগুলোর জবাবদিহিতাও নেই। তবে সম্পদের অপ্রতুলতাই সবচেয়ে বড় কারণ। স্বাস্থ্যখাতে পর্যাপ্ত খরচ করা হয় না।
কোন আইনের খসড়া করার আগে সংশ্লিষ্ট মহলকে বা স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করে সংলাপের আয়োজন করা উচিত বলেও মত দেন ব্যারিস্টার রাশনা। নইলে সেই আইন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। তার সাথে একমত হয়ে ডা. সুমনও বলেন, যে কোন আইন বিশেষ করে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আইনগুলো করার সময় এ বিষয়ে যারা ভালো জানেন অনেক ক্ষেত্রেই তাদের মতামত নেয়া হয় না। তাই আইন হলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ করা হয়ে উঠে না।
হাসপাতাল বা ক্লিনিক এ মনিটরিং এর নামে ভয় দেখিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ দুর্নীতি করে টাকা হাতিয়ে নেয়, কাজের কাজ কিছুই করে না বলে মনে করেন পিয়াল।
ব্যারিস্টার রাশনা বলেন, করোনাকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে একের পর এক নির্দেশনা আসলেও কোন আইনের বলে এগুলো করা হচ্ছে তা উল্লেখ করা হয়নি। স্বাস্থ্যখাতে আইন যা আছে তারও প্রয়োগ হচ্ছে না।
ডা. সুমন মনে করেন, দেশে ১৭ কোটি মানুষের জন্য সাস্থ্যখাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয় তা অত্যন্ত কম। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। এটা বৃদ্ধি না করলে কখনোই যথোপযুক্ত অবকাঠামো তৈরি সম্ভব হবে না। তবে দেশে প্রায় সব ধরনের চিকিৎসা থাকলেও অনেকে অকারণেই বিদেশে চিকিৎসার জন্য যান। আবার দেশে অনেকেই অকারণে ছোট রোগের জন্য বড় চিকিৎসকের পেছনে ছুটেন। এক্ষেত্রে জনসাধারণের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রতিবেশী দেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার সুযোগ থাকলেও সেখানে করোনার প্রকোপ বেশি হওয়ায় সেখানে যাওয়াটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি। এছাড়া করোনার উপসর্গ থাকা স্বত্ত্বেও তা লুকানো চিকিৎসক সহ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য জীবনের ঝুঁকি বয়ে আনে, তাই করোনাসহ সব রোগের ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের কাছে কোন কিছু গোপন না করা উচিত। অনেকেই এখন আর মুখে মাস্ক পরছেন না উল্লেখ করে তিনি এর জন্য আইনগত বিধিমালা তৈরির উপর জোর দেন।
রোগীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সেবা বাবদ অতিরিক্ত অন্যায্য এবং অতিরিক্ত চার্জ আরোপের প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার রাশনা বলেন, ১৯৮৫ সালের অর্ডিন্যান্সে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং প্রাইভেট চেম্বারে ‘সার্ভিস চার্জ’ নির্ধারণে কিছু নিয়ম বেঁধে দেয়া হলেও সেগুলো সময়ের প্রয়োজনে এখন পরিবর্তন করা জরুরি। জবাবদিহিতা বা মনিটরিং নেই বলেও অনেক সময় ভুল চিকিৎসা বা এ সংক্রান্ত কারণে বিরক্ত হয়ে জনগণ আইন নিজের হাতে তুলে নেন বা চিকিৎসকরা জনতার হাতে নিগ্রহের শিকার হন। চিকিৎসকদের সুরক্ষা প্রচলিত অনেক আইনে সম্ভব হলেও তার প্রয়োগ হচ্ছে কিনা সেদিকে নজর দিতে হবে।
দুর্নীতিবাজ-প্রতারক পুলিশ বা সংঘবদ্ধ অপরাধ থেকে সুরক্ষায় হাসপাতালগুলোতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা রাখার জন্য প্রয়োজনে সুনির্দিষ্ট আইন করা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। ডা. সুমন তার সাথে একাত্ম হয়ে যোগ করেন, একজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বা বিচারককে আঘাত করলে যেমন বিশেষ সুরক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের জন্যও তা করা প্রয়োজন। রোগীর স্বজনদের আক্রমণ বা আক্রোশের শিকার হবেন, এই ভেবে অনেক চিকিৎসক অনেক সময় গুরুতর অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারলেও তা না করে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেন। এতে দিনশেষে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওই রোগীরাই।
তাছাড়া ফরেনসিক মেডিসিনের চিকিৎসকরা প্রায়ই স্থানীয় সন্ত্রাসীদের হুমকির শিকার হন উল্লেখ করে তাদের জন্য সরকারের ‘বিশেষ সুরক্ষা’র ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি। নইলে তাদের কাছ থেকে ময়নাতদন্তের প্রকৃত সুরতহাল প্রতিবেদন আশা করা ঠিক হবে না। আর সেক্ষেত্রে সঠিক বিচারও পাওয়া যাবে না। ব্যারিস্টার রাশনা সহমত পোষণ করে বলেন, দেশে প্রত্যক্ষদর্শী এবং নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষায় কোন আইন নেই।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত সাপ্তাহিক এই ওয়েবিনারের একেবারে শেষে সদ্যপ্রয়াত সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং বাংলাদেশের সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়।