নিউজিল্যান্ড যেভাবে করোনা রুখে দিলো…
কভিড-১৯ মহামারী থেকে গত ৮ জুন নিজেদের মুক্ত ঘোষণা করেন নিউজিল্যান্ড প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। যদিও লকডাউন শিথিল করায় জুনের শেষ দিকে নিউজিল্যান্ডে দুজন নতুন করে আক্রান্ত শনাক্ত হন। ওই সময় ভাইরাসটির সংক্রমণ সারাবিশ্বে ঢেউ তোলে এবং অনেক দেশে দিনেই হাজার হাজার শনাক্ত হতে থাকে। তাই নিউজিল্যান্ডে দুজনের শনাক্ত হওয়ার ঘটনা খুব বেশি দুশ্চিন্তার ছিল না। কিন্তু নিউজিল্যান্ডজুড়ে সতর্কতা ঠিকই জারি ছিল। তাইতো ওই ঘটনার পরবর্তী ২৪ দিন নতুন করে কেউ শনাক্ত হয়নি।
নিউজিল্যান্ডে করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধ নিয়ে নিয়ম এতটাই কঠোর ছিল যে কোয়ারেন্টিন আইন ভঙ্গ করায় স্বাস্থ্য মন্ত্রী পদত্যাগ করে বসলেন! কভিড-১৯ সফলতার পেছনে নিউজিল্যান্ডের কী ছিল কৌশল?
সীমান্ত বন্ধ করার সিদ্ধান্ত
গত ২ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনে প্রথম চীনের বাইরের কেউ কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ওই মুহূর্তে নিউজিল্যান্ডে কেউ শনাক্ত না হলেও পরের দিনই সিদ্ধান্ত আসে, সরাসরি চীন থেকে কিংবা চীন হয়ে আসা কোনো বিদেশি নাগরিককে ঢুকতে দেয়া হবে না। আর নিউজিল্যান্ডের কোনো নাগরিক চীন থেকে ফিরলে তাকে ১৪ দিনের সঙ্গনিরোধ অবস্থায় থাকতে হবে।
ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় বহু দেশের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়, এমনকি ইরানের সঙ্গেও, নিউজিল্যান্ডের প্রথম শনাক্ত ব্যক্তিটি ইরানের সঙ্গে সম্পর্কিত। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া ও উত্তর ইতালি থেকে আসা ব্যক্তিদের কোনো উপসর্গ দেখা গেলেই তাদের ক্ষেত্রে বেশ কড়াকড়ি নিয়ম আরোপ করা হয়।
১৬ মার্চ থেকে নিজেদের নাগরিক হোক কিংবা বিদেশী, নিউজিল্যান্ডে প্রবেশ করলেই বাধ্যতামূলক সঙ্গনিরোধ আইন পালন করতে হচ্ছিল। যদিও একেবারেই ভাইরাসের ছোঁয়া না লাগা প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ থেকে আসা মানুষজন ছাড়া।
প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা বলেন, তাদের আরোপ করা নিয়ম বিশ্বের মধ্যে কঠিনতম, তবে এ নিয়ে তার কোনো ‘অনুতাপ’ নেই।
এর কয়েকদিন পরই নজিরবিহীন এক সিদ্ধান্তে প্রায় সব বিদেশির জন্য সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। ম্যাসি ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ মার্টিন বেরকা এ নিয়ে বলেন, ‘যখন বিশে^ মাত্র কয়েক হাজার সংক্রমণের ঘটনা ঘটে তখনই দ্রুত ব্যবস্থায় নেয়ায় মানুষের অবাধ যাতায়াত বন্ধ ও কমিউনিটি সংক্রমণ বন্ধ করার সফলতা আসে।’
আগেভাগেই লকডাউন কার্যকর ও পরিপূর্ণ নির্মূল
নিউজিল্যান্ডের অন্যতম শীর্ষ এপিডেমিওলজিস্ট অধ্যাপক মাইকেল বাকের বলেন, মধ্য মার্চে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, ফ্লু মহামারীর জন্য যে সচরাচর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় সেই মানের পদক্ষেপ দিয়ে করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
জানুয়ারির শেষ দিকে চীনের উহানে কভিড-১৯ জয়ের প্রতিবেদন দিচ্ছিল বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা। সেই প্রতিবেদন থেকে নিউজিল্যান্ড বুঝতে পারে, যা করতে হবে শুরুতেই এবং সম্পূর্ণ নির্মূল করার পরিকল্পনা নিতে হবে। বাকের বলেন, ‘বৈজ্ঞিানিক নিশ্চয়তার সাধারণ মাত্রার বাইরে যেতে হলো আমাদের এবং তথ্যপ্রমাণ ঘেটে আমরা বলতে পারছিলাম, এটা চীনে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।’
মার্চের শেষ দিকে নিউজিল্যান্ডের মানুষকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হলো, চালু হলো চার ধাপের অ্যালার্ট সিস্টেম। এর মধ্য দিয়ে বর্তমান সময়ের ঝুঁকি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়।
সিস্টেমের শুরু হয় লেভেল-টু দিয়ে, যদিও ২৫ মার্চ এটি লেভেল-ফোরে উন্নীত হয়। দেশজুড়ে পরিপূর্ণভাবে লকডাউন কার্যকর করা হয়, তখন শুধু জরুরি প্রয়োজনে কিছু গাড়ি চলার অনুমতি ছিল এবং মানুষজনকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়।
ওই সময় নিউজিল্যান্ডে মাত্র ১০২ জনের শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয় এবং কেউ মৃত্যুবরণ করেনি। অথচ যুক্তরাজ্যে ৬ হাজার ৫০০ জন কভিড-১৯ শনাক্ত ও ৩৩০ জনের মৃত্যুর পর একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আবার যুক্তরাজ্যে কখনই সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়নি, যেমনটি করেছে নিউজিল্যান্ড।
কার্যকর যোগাযোগ ও জনগণের অনুবর্তিতা
অধ্যাপক বাকের বলেন, নিউজিল্যান্ডে লকডাউন কার্যকরে কর্মকর্তারা অবিশ্বাস্য কাজ করেছেন। এমনকি সংক্রমণের শিখরে পৌঁছার পরও দেশটিতে দিনে ৮৯ জনের বেশি শনাক্ত হয়নি। বাকেরের কথায়, ‘অভাবনীয় এই কাজটি পালনে তারা (কর্মকর্তা) জনগণের মন ও হৃদয়কে যুক্ত করে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘বাড়ি যাও ও নিজেদের মঙ্গলের জন্য সেখানে ছয় সপ্তাহ থাকো।’
লকডাউনের সময় ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা আর কন্টাক্ট ট্রেসিং অপারেশন পরিচালনা করা হয়। কোনো একজন আক্রান্ত শনাক্ত হলেই তার সান্নিধ্যে যারা এসেছেন তাদের সবাইকে সতর্ক করে দেয়ার পাশাপাশি আইলোশনে পাঠানো হয়।
নিউজিল্যান্ডের এই দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের প্রশংসা করে খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই বলেছে, অন্য দেশগুলোর জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে প্রশান্ত মহাসাগরের এ দ্বীপদেশটি।
বিচ্ছিন্ন দ্বীপ আর অল্প জনসংখ্যাই কি সুবিধা করে দিয়েছে নিউজিল্যান্ডকে?
নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে কোনো দেশের সরাসরি স্থল সীমানা নেই। ছয়শ’রও বেশি দ্বীপ নিয়ে গঠিত ২ লাখ ৬৮ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ৫০ লাখ। এ দুটি বিষয় দেশটিতে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সুবিধা দিয়েছে কি? যদিও বাকের বলছেন, এসব আসলে নগন্য সুবিধা। তার কথায়, ‘ভালো কৌশল যেকোনো জায়গায় কাজ করতে পারে, যা কিনা সরকার ও অবকাঠামোকে পরিচালনা করে।’
যুক্তরাজ্যের এত উন্নত বৈজ্ঞানিক অবকাঠামো ও স্বাস্থ্যসেবা খাত থাকার পরও ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণ করতে ধুঁকছে, যা অবাক করেছে বাকেরকে। যদিও যুক্তরাজ্য সরকার শুরু থেকেই করোনাভাইরাস নিয়ে নিজেদের কৌশলকে সমর্থন করে এসেছে এবং বলেছে, এখানে তারা বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সূত্র: বিবিসি