রাশিয়ার হামলায় ভয়াবহ বিপর্যয়ে ইউক্রেন, বিদ্যুৎহীন ১০ লাখের বেশি পরিবার
শীত শুরুর মুখে ইউক্রেনের বিদ্যুৎব্যবস্থায় বড় ধরনের আঘাত হেনেছে রাশিয়া। রাতভর চালানো হামলায় দেশটির জ্বালানি ও শিল্প অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এতে ১০ লাখেরও বেশি পরিবার বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। ভয়াবহ এই হামলা চালাতে প্রায় পাঁচশোটি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে রাশিয়া। অবশ্য যুদ্ধ থামাতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার হলেও শান্তিচুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি।
সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, রাশিয়ার রাতভর হামলায় ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দেশটিতে অন্তত ১০ লাখের বেশি পরিবার বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইহোর ক্লাইমেনকো জানান, পাঁচটি অঞ্চলে এই হামলা চালানো হয়েছে এবং এতে অন্তত পাঁচজন আহত হয়েছেন। আগুন নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরুদ্ধারের কাজ চলছে।
মূলত যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইউক্রেনের বিদ্যুৎ অবকাঠামো রাশিয়ার হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে আছে। তবে শীত ঘনিয়ে আসায় সাম্প্রতিক সময়ে এসব হামলা আরও জোরদার করেছে মস্কো। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ বন্ধে আলোচনা চালাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত এ সপ্তাহান্তে জার্মানিতে যাচ্ছেন। সেখানে তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
হোয়াইট হাউসের পক্ষে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে মধ্যস্থতার দায়িত্বে থাকা স্টিভ উইটকফ বার্লিনে প্রস্তাবিত শান্তিচুক্তির সর্বশেষ খসড়া নিয়ে আলোচনা করবেন।
শনিবার ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি জানান, রাতের বেলা চালানো এই হামলায় রাশিয়া ৪৫০টির বেশি ড্রোন ও ৩০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্লাইমেনকো বলেন, রাশিয়ার এই হামলায় ডিনিপ্রোপেত্রোভস্ক, কিরোভোহরাদ, মিকোলাইভ, ওডেসা ও চেরনিহিভ অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, হামলায় তারা কিনঝাল হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এসব ক্ষেপণাস্ত্র আকাশপথে চলার সময় দিক পরিবর্তন করতে পারে, ফলে এগুলো শনাক্ত করা কঠিন।
আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, ব্যাপক সামরিক তৎপরতার কারণে ইউক্রেনের জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সাময়িকভাবে বাইরে থেকে সব বিদ্যুৎ সংযোগ হারিয়ে ফেলেছিল। পরে সংযোগ পুনরুদ্ধার করা হয়। রুশ নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় অবস্থিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বর্তমানে চালু না থাকলেও রিঅ্যাক্টর ঠান্ডা রাখতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রয়োজন।
অন্যদিকে রাশিয়ার সারাতোভ অঞ্চলের গভর্নর রোমান বুসারগিন জানিয়েছেন, ড্রোন হামলায় সেখানকার একটি আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সেখানে দুজন নিহত হয়েছেন।
বিবিসি বলছে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান এই যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বেশ সক্রিয় এবং তারা আসন্ন বড়দিনের আগেই যুদ্ধ বন্ধের একটি চুক্তি করতে চায়। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইউক্রেন ও রাশিয়ার প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক দফা আলোচনা হলেও এখনও বড় কোনও অগ্রগতি দেখা যায়নি।
এদিকে বার্লিনের আসন্ন বৈঠকে কোন কোন ইউরোপীয় নেতা অংশ নেবেন, তা আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হয়নি। তবে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ এই বৈঠকে থাকতে পারেন। এছাড়া এই বৈঠকের আগে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের সংশোধিত ২০ দফা শান্তি প্রস্তাব দিয়েছে। নভেম্বরের শেষ দিকে প্রথম উত্থাপিত এই প্রস্তাব ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা দেখা গেছে।
মূলত আলোচনার সবচেয়ে জটিল বিষয় হয়ে আছে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় ভূখণ্ড। কিয়েভ অবৈধভাবে দখল করা কোনও এলাকা রাশিয়ার কাছে ছাড়তে রাজি নয়। অন্যদিকে মস্কো জানিয়েছে, ইউক্রেন সেনা প্রত্যাহার না করলে তারা বলপ্রয়োগ করে পুরো ডনবাস অঞ্চল দখলে নেবে। ভূখণ্ড সংক্রান্ত বিষয়ে হোয়াইট হাউসের সর্বশেষ প্রস্তাব নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় সেনারা ওই অঞ্চল ছেড়ে যাবে এবং এলাকাটিকে ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
জেলেনস্কি সাংবাদিকদের বলেন, প্রস্তাব অনুযায়ী রাশিয়া প্রতিশ্রুতি দেবে যে ইউক্রেনীয় সেনারা সরে যাওয়ার পর তারা ওই এলাকায় আর অগ্রসর হবে না। এতে রুশ নিয়ন্ত্রিত ডনবাস অঞ্চল ও ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা লাইনের মাঝখানে কার্যত একটি নিরস্ত্রীকৃত এলাকা তৈরি হবে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘রাশিয়াকে অগ্রসর হওয়া থেকে কে থামাবে? বা তারা যদি সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে ঢুকে পড়ে, তখন কী হবে?’
এদিকে শান্তি প্রস্তাবের সর্বশেষ খসড়ায় ইউক্রেনের দ্রুত ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের কথাও বলা হয়েছে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রাসেলস এ বিষয়ে সমর্থন দিয়েছে। ইউক্রেন ২০২২ সালে ইইউতে যোগদানের আবেদন করলেও সদস্য হতে এখনও কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। তবে এএফপির খবরে বলা হয়েছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউক্রেন ২০২৭ সালের জানুয়ারিতেই ইইউ সদস্য হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.