বিশ্বে এখন বেশি আলোচিত বিষয় “করোনা”। করোনার ঝড় লাগেনি এমন দেশ আজকে খুব বেশি বাকি নেই এই ধরিত্রীতে। দেশে দেশে চলছে মৃত্যুর মিছিল। যখন এই শব্দটি টাইপ করা হলো সেই সময় হয়তো কেউ না কেউ এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছে তা আমরা জানি না। তাই দেশে দেশে, সমাজে সমাজে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে চলছে করোনা প্রতিরোধের নানা উদ্যোগ। মহামারি করোনার যেহেতু নির্দিষ্ট প্রতিকার নেই, তাই প্রতিরোধই উত্তম ব্যবস্থা।
প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং করছে। আগামী ১৪ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত সরকারি বেসরকারি সকল অফিস বন্ধ ঘোষণা করেছে করকার। সরকারি ঘোষণার পর থেকে ঢাকায় যা শুরু হয়েছে তা পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো কালে হয়েছে বলে মনে হয় না। মানুষের ঢল মেনেছে রাজধানী থেকে গ্রামের বাড়ির পথে। এ যেন ঈদ উৎসব যাত্রাকে-ও হার মানিয়েছে। অনেকের মত আমার মনেও প্রশ্ন একি কোনো উৎসবের ছুটি?
এতো কোনো উৎসবের ছুটি নয়। এটা এক ধরনের জরুরী পরিস্থিতে অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। লোকদেরকে ঘরের বাইরে না যাওয়ার জন্য এই বন্ধ। দল বেধে গ্রামে আত্মীয় পরিজনের সাথে সময় কাটাতে যাওয়ার জন্য এই বন্ধ না। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ এই কথা শুনছে না বা মানছে না কেন? এই সমাজের মানুষের কি সেই বোধ নেই? মানুষ কি তাঁর নিজের ভালো বেঝেন না? নিশ্চয় নিজের ভালো বোঝেন। মানুষ কি জানেন না যে করোনা একটা সংক্রমক ব্যাধী? এটি সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে একাধিক ব্যক্তিতে চাড়ায়! বেশিরভাগ লোক জানেন না তা হতে পারে না। হয়তো অল্প কিছু মানুষ এখনো নাও জানতে পারেন এর ভয়াবহতা সম্পর্কে। যারা জানেন না তাদের কথা বাদ দিয়েই বলা যায়, যারা জানেন তারাও কেন ছুটছেন শহর থেকে গ্রামের দিকে? তাঁরাতো লিখতে পড়তে পারেন? স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া-শুনা করেছেন? লেখা-পড়া জানা লোকের তো এমন আহম্মকের মত আচরণ করা উচিৎ নয়।
বাংলাদেশে অনেক মানুষ কেন এমন আচরণ করছে এবং করে?
এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া সম্ভব না। অনেকে অনেক কথা বলছেন এবং বলবেন। কেউ বলবেন বাঙালি আবেগ প্রবন জাতি তাই লম্বা ছুটিতে নাড়ির টানে ঘরে ফেরা। কেউ বলবেন খেটে খাওয়া মানুষের কাজ নেই তাই তাঁরা গ্রামে ফিরছেন। হয়তো এগুলোর সবকটিই সত্য; তাই বলে কোনো সুস্থ মানুষ কি জেনে বুঝে তাঁর প্রিয়জন তথা পরিবারের সদস্যদের বিপদের মধ্যে ফেলার ঝুকি নেয়?
এই ঘরে না থাকার পরিনাম যে কত ভয়াবহ হতে পারে তা কিন্তু বিশ্ব দেখেছে এবং দেখছে। আমি একটু অন্যভাবে বিষয়টা দেখতে চাই। আমরা বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনগণ বাঙালি। বাঙালি জাতীয়তাবোধের ধারায় এই রাষ্ট্রের বিকাশ হওয়ার কথা। অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত দিক দিয়ে বিকশিত হলেও বাঙালি সংস্কৃতি তথা জাতীয়তাবোধের ধারায় কি এই রাষ্ট্র বিকশিত হয়েছে বা হচ্ছে? আমার মতে মূল ঘাটতি আসলে এখানেই।
একটি সমাজ বেড়ে ওঠে তার সংস্কৃতিকে বেজ করে। আর সংস্কৃতি সমৃদ্ধ সমাজ একটি জাতিরাষ্ট্র গড়ে উঠতে সহায়তা করে। সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্র তৈরি করার প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রের। প্রশ্ন হচ্ছে আমারদের রাষ্ট্র কি এই ভূখন্ডের জনগণের সংস্কৃতি বিকাশের জন্য প্রতিষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ নিয়েছে? সংস্কৃতি মানে তার ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, উৎপাদন, পোষাক, সামাজিক জীবন ও আচার অনুষ্ঠান। বাঙালি সমাজে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন, শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা, সহযোগিতা, বন্ধুভাবাপন্নতা, অতিথিপরায়নতা, উপকারী এবং উৎসব প্রিয়তা সর্বদা লক্ষণীয়।
একটি জাতিযোষ্ঠী যখন তার নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তুলবে তবেই না তার জাতিরাষ্ট্রের চরিত্র প্রকাশিত হবে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের মূল ভিত্তি বাঙালি সংস্কৃতি তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদ হলেও বাস্তবে বাঙালি সমাজের মূল প্রাণ শ্রদ্ধাবোধ, অপরের প্রতি সম্মান, সহমর্মীতা, ভ্রাতিত্ববোধ, উপকারবোধ, সামাজিক দায়বদ্ধতার চেতনা ও এগুলোর চর্চার অভাব লক্ষণীয়।
ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ক্রমশ রাষ্ট্রযন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে জন্ম নেওয়া দেশটির সম্ভাবনা ছিলো একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার। কেন হয়নি? কার দায় বেশি, সেদিকে না গিয়ে বরং বলা যায়, যদি বাংলাদেশটি একটি জাতিরাষ্ট্রের রূপ পেত তাহলে কি জনগণ বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণাকে ছুটি হিসেবে ভাবতো? ছুটি এবং বন্ধ শব্দ দুটির মধ্যকার চেতনাগত পার্থক্য কি আমরা বুঝিনা? ছুটির সাথে যেমন আনন্দযোগ তেমনি বন্ধের সাথে শঙ্কা বা ভয় মিশ্রিত থাকে এটা বোঝা খুব কি কঠিন আমাদের পক্ক?
নিজের এবং সমাজের অমঙ্গল হবে জেনেও নিজ ঘরে না থেকে পাড়ায় কিংবা বাইরে থাকতো? পরিবার পরিজনদের নিরাপত্তার ঝুকি বাড়িয়ে ঘরে ফেরার জন্য দীর্ঘ লাইন দিত? কখনোই না। জাতিরাষ্টের একজন নাগরিক নিজের ক্ষেত্রে যেমন সচেতন তেমনি অপরের ক্ষেত্রেও সমান সজাগ। হোক সে নিজ পরিবার কিংবা সমাজের কেউ। জাতিরাষ্ট্রের অন্য নাম কল্যাণ রাষ্ট্র। মূলত কল্যাণ রাষ্ট্র অথবা জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রধান ভিত্তি হলো নাগরিকেকে তার নিজ নিজ সংস্কৃতির উপাদানগুলোর সমন্বয়ে ঢেলে সাজাতে হয় এর শিক্ষা ব্যবস্থাকে। মূলকথা হলো শিক্ষা ব্যবস্থায় যদি সমাজিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির উপাদানগুলো না থাকে তাহলে নাগরিকে শিক্ষিত হয় ঠিকই কিন্তু নাগরিক হয়ে ওঠে না। যেমনটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটেছে।
লেখক পরিচিতিঃ
ডেপুটি ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর
সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি,
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো
ঢাকা, ১২০৮।