জৌলুস হারাচ্ছে কামারপাড়া, নেই আগের মতো ব্যস্ততা

কামারপাড়ায় কাছাকাছি পৌঁছাতেই কানে আসে লোহা পেটানোর শব্দ। কাঠ কয়লার আগুনে উত্তপ্ত লাল লোহায় সজোরে আঘাত করে দা, বঁটি, ছুরি, কাস্তে, কুঠারসহ বিভিন্ন লোহার সরঞ্জাম বানান কামার বা কর্মকাররা। আসন্ন ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ উপলক্ষে কামারপাড়ায় এখন ব্যস্ততা থাকার কথা হলেও আগের মত ব্যস্ততা নেই পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শ্রীরামকাঠী বন্দরে। এতে মুখে হাসি নেই কামারদের।

তারা বলছেন, মূলত মেশিনে তৈরি সরঞ্জামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারছেন না তারা। আগের দিনে এই সময় যে ব্যস্ততা থাকতো, আয় উপার্জন হতো; সেই তুলনায় এখনকার ব্যস্ততা কিছুই না। এখন সাধারণ সময়ে যা আয় হয়, তাতে সংসার চালানোই দায় হয়ে ওঠে তাদের।

 

অনেকে এই পেশা ছেড়ে চলে গেছে অন্য পেশায়। কেউ কেউ দেনার কারণে দোকান রেখে পালিয়ে গেছে। এখন যারা আছেন এ পেশায় তারা সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার  কাছে তাদের জন্য সহোযোগিতা কামনা করেন।

পিরোজপুরের নাজিরপুর ঐতিহ্যবাহী শ্রীরামকাঠী বন্দরের কামারপাড়ায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেলো তাদের ব্যস্ততা। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো তাদের বর্তমান জীবনচিত্র। তাদের বেশিরভাগই দীর্ঘ সময় ধরে এই পেশায়। কেউই চান না তাদের পরের প্রজন্ম এই পেশায় থাকুক। তাদের ভাষ্য, পারলে নিজেরাও পেশা ছেড়ে দিতেন। কিন্তু অন্য তেমন কোনও কাজ না জানায় একরকম নিরুপায় হয়েই পেশা ধরে রেখেছেন তারা।

১৫ বছর বয়স থেকে কামারের কাজ করেন মিন্টু কর্মকার। বর্তমানে তার বয়স ৪৫। ৩০ বছর হয়েছে তিনি এই পেশায় যুক্ত আছেন। পরিবার পাঁচ সদস্যের পরিবার। মেয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। এখন তার উপার্জনেই চলছে পাঁচ জনের সংসার।

মিন্টু কর্মকার বলেন, আমার একার আয়েই সংসার চলছে। এখন আমার সংসার চলছে দিন আনি দিন খাই অবস্থায়। প্রতিদিনের আয় প্রতিদিন করি। আমাদের মাসিক কোনও নির্দিষ্ট আয় নেই। প্রতিদিন যা আয় করি। এরমধ্যে দুই কর্মচারীকে দিতে হয় ১২০০ টাকা, বাকি টাকা দিয়ে আমার সংসার চলে।

কামারের পেশায় এখন আর আগের মতো ব্যবসা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, একসময় অনেক আয় করতাম। লাখ টাকার কাজও করেছি। আবার ৫০ হাজার টাকার কাজ করলে শ্রমিকদের বেতন, কয়লার খরচ দিয়ে ৩৫-৪০ হাজার টাকা থাকতো। কিন্তু এখন আর আগের অবস্থা নাই। আমরা আর বড় কাজ পাই না। ছোটখাটো কাজ করি।

আবার এখন অনেক আধুনিক মেশিন আসছে, সব যন্ত্রপাতি এখন মেশিন দিয়ে কাটে। আগে এগুলো আমরা হাতে তৈরি করতাম। কামারের কাজ এখন নাই বললেই চলে। বছরের বেশিরভাগ সময় আমরা বসে থাকি। টুকটাক করে জীবন চলে।

কোরবানির ঈদের আগের ১০ দিন আয় কিছুটা বাড়ে কিন্তু এ বছর সেটা হচ্ছে না। ঈদের উপার্জন দিয়ে একটু ভালো চলার চেষ্টা করি তারপর সারা বছর রোজ কামাই, রোজ খাই।

৬০ বছর বয়সের সঞ্জয় কর্মকার ৪০ বছর ধরে কামারের পেশায় যুক্ত আছেন। একপর্যায়ে এসে তিনি নিজেই অনেককে কামারের কাজ শিখিয়েছেন। কিন্তু ভাগ্য বদলাতে পারেননি।

সঞ্জয় বলেন, এক সময় অনেক কাজ করেছি। এখন আর কাজ পাই না। মেশিনে বানানো যন্ত্রপাতির দোকানও বেড়েছে। এটাতে আমরা যারা হাতে কাজ করি, তাদের ক্ষতি হয়েছে, আয় কমেছে।

এখন আমার দৈনিক গড়ে আয় হয় ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। আমার সাত ছেলে-মেয়েসহ ৮ জনের সংসার। বোঝেন এবার কীভাবে চলছে আমার সংসার। আমার একার আয়েই চলছে আমার সংসার।

সঞ্জয় জানালেন, কোরবানি ঈদের আগের কয়েকটা দিন তার উপার্জন ভালো হয়। এই কয়দিন তিনি দৈনিক গড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা উপার্জন করেন।  কিন্তু এবছর এখনো তেমন আয় শুরু হয় নাই।  এতে তার অর্থনৈতিক কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে।

শ্রীরামকাঠী কামারপাড়ায় অন্যের দোকানে কাজ করেন সমীর কর্মকার। প্রায় ২০ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত তিনি। নিজের দোকান দেওয়ার মতো অবস্থা এখনও তার হয়নি। তবে দোকান না থাকাতে ভালোই হয়েছে বলে জানান তিনি। লাভ-লসের হিসাব তাকে বইতে হয় না, কাজ করে শুধু টাকা নিয়ে যান।

সমীর কর্মকার বলেন, আমি রোজ হিসেবে (দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে) কাজ করি। প্রতিদিন আমার মজুরি এক হাজার টাকা। আমি ধরতে গেলে প্রতিদিনই কাজ করি, মিস দেই না। এই ইনকামে আমার সংসার চলে যাচ্ছে। আমার পরিবারে আমি, আমার স্ত্রী আর আমাদের একটা মেয়ে আছে, সেভেনে পড়ে। এই তিন জনের সংসার আমার আয়ে চলে যাচ্ছে।

মেয়েকে নিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমার যতদূর কুলায় আমি মেয়েকে পড়াশোনা করাবো। আমার ইচ্ছা আমার মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হোক।

কথা হয় কামারপাড়ার সুধীর কর্মকার, দেবাশীষ ব্যাপারীসহ আরো কয়েকজনের সঙ্গে সবাই জানান, এ পেশা প্রায় বিলুপ্তর পথে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় হারিয়ে যাবে এ শিল্প। সরকার যদি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করে তাহলে হারিয়ে যাবে কামরপাড়ামা

স্থানীয় অশোক কর্মকার বলেন, আমাদের বাপ-দাদারা এ পেশা ছিলো। এক সময় এ পাড়ার শব্দে রাতে ঘুমাতে পারতাম না। আর কোরবানি আসলে তো দিন-রাত কি বুঝতাম না সব সময় টুংটাং শব্দে মুখরিত থাকত। সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার কাছে আমার অনুরোধ এই পেশাটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে তাদের সাহায্য করতে হবে।

শ্রীরামকাঠী বন্দর কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাজেদুল কবির রাসেল বলেন, এক সময়ের জৌলুস ফুরিয়ে গেছে কামারপাড়ায়। বন্ধ হতে যাচ্ছে এ শিল্প। দোকান রেখে পালিয়ে যাচ্ছে অনেকে। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের উদার মনের হত হবে। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাদের সকলের।

-পিরোজপুর প্রতিনিধি

You might also like

Comments are closed.