করোনাভাইরাসঃ লক্ষণ, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ
ভাইরাস কি?
ভাইরাস হল অতি আণুবীক্ষণিক (উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না) সংক্রমণক্ষম অকোষীয় বস্তু যা শুধুমাত্র উপযুক্ত জীবকোষের মধ্যে বংশবিস্তার করতে পারে, এবং জীবকোষের বাইরে যেমন বাতাসে কিংবা পানিতে জড় বস্তুর মত আচরন করে। এদের আকার প্রকারভেদে ২০-১০০০ ন্যানোমিটার (১ ন্যানোমিটার হল ১ মিলিমিটারের ১০ লাখ ভাগের ১ ভাগ) পর্যন্ত হতে পারে। যেমন- ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের আকার (ব্যাস) ১০০ ন্যানোমিটার, ডেঙ্গি ভাইরাস ৫০ ন্যানোমিটার, এইচআইভি ১২০ ন্যানোমিটার, সার্স কোভ-২ (কভিড-১৯) ৫০-২০০ ন্যানোমিটার ইত্যাদি।
ভাইরাস কি দিয়ে তৈরি?
ভাইরাসের গঠন খুব সাধারণ। এরা সাধারনত দুটি উপাদান দিয়ে তৈরিঃ প্রোটিন (যা ক্যাপসিড নামক এক প্রকারের গঠন তৈরি করে) এবং নিউক্লিক এসিড (ডিএনএ বা আরএনএ)। ভাইরাসে শুধু ডিএনএ বা আরএনএ-এর যেকোন একটি থাকে, দুটি একসাথে নয়। ভাইরাসের নিউক্লিক এসিডের আকার কয়েক হাজার থেকে আড়াই লাখ নিউক্লিওটাইড পর্যন্ত হয়। ক্যাপসিড ভাইরাসের নিউক্লিক এসিডকে ঘিরে থাকে এবং এর প্রতিরক্ষা দেয়। কিছু কিছু ভাইরাসের উপরে আরেকটি অতিরিক্ত আবরণ থাকে যাকে এনভেলপ বলে। ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গি, এইচআইভি, সার্স কোভ-২ (কভিড-১৯) ইত্যাদি সকল ভাইরাসের বাইরে এই অতিরিক্ত এনভেলপ আছে।
পৃথিবীতে কতোগুলো ভাইরাসের প্রজাতি আছে?
পৃথিবীতে কতোগুলো ভাইরাসের প্রজাতি আছে তা এখনো অজানা তবে ভাইরাসের নামকরণের আন্তর্জাতিক কমিটি (আইসিটিভি) এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার ভাইরাসের প্রজাতির নামকরণ করতে পেরেছে। নতুন নতুন ভাইরাস আবিস্কার হচ্ছে যেমন গত ডিসেম্বরে আবিস্কার হয়েছে সার্স কোভ-২ নামে নতুন এক ভাইরাস সনাক্ত হয়েছে যা চীন থেকে গত দুই মাসে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
করোনাভাইরাস কি?
করোনাভাইরাস হল করোনাভিরিডি গোত্রের ভাইরাসের একটি গ্রুপ। করোনাভিরিডি গোত্রকে চারটি জেনাস বা গণে ভাগ করা হয়েছে। প্রত্যেকটি গণের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি করে প্রজাতি। এ প্রজাতিগুলো মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণীকে সংক্রমণ করতে পারে।
এ পর্যন্ত করোনাভাইরাস গ্রুপের মোট সাতটি ভাইরাস মানুষের রোগ তৈরি করতে পারে বলে সনাক্ত হয়েছে । এগুলো হলঃ HCoV-229E, HCoV-OC43, SARS-CoV, HCoV-NL63, HCoV-HKU1, MERS-CoV এবং SARS-CoV-2।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানেই কি মৃত্যু?
না। এর আগে ২০১২, ২০১৫ এবং ২০১৮ সালে করোনাভাইরাসের একটি প্রজাতি MERS-CoV-এর প্রভাবে যথাক্রমে ৪০০, ৩৬ এবং ৪১ জন এবং ২০০৩ সালে আরেকটি প্রজাতি SARS-CoV-এ ৭৭৪ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিলো। MERS-CoV-এ আক্রান্ত ব্যাক্তিদের মধ্যে প্রায় ৩৫ ভাগের মৃত্যু হয়েছিলো এবং SARS-CoV-এ আক্রান্তদের মৃত্যুহার ছিল ৯%।
এখন সারা বিশ্বে যে করোনাভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে সেটি হল SARS-CoV-2 (প্রথমে এটার নাম দেয়া হয়েছিলো 2019-nCov) এবং এর দ্বারা তৈরি করা রোগের নাম কভিড-১৯। SARS-CoV-2 বেটাকরোনাভাইরাস গণের একসুত্রক আরএনএ ভাইরাস। এর আরএনএ ৩০,০০০ নিউক্লিওটাইড লম্বা। এ ভাইরাসটি এ পর্যন্ত সারা প্রায় দুই লাখ মানুষকে আক্রান্ত করেছে যার মধ্যে মারা গেছে প্রায় আট হাজার (১৮ মার্চ ২০২০ পর্যন্ত)। সুতরাং, কভিড-১৯-এ এ পর্যন্ত মৃত্যুহার প্রায় ২.৫%। তাঁর মানে, কভিড-১৯-এ আক্রান্ত মানে মৃত্যু নয়।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে সুস্থ্য হওয়ার সম্ভাবনা কেমন?
প্রায় আশি ভাগ ক্ষেত্রেই এটি হাল্কা জ্বর, শুষ্ক কাশি দিয়ে শুরু হয় এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে রোগী এমনিতেই সেরে উঠে। এগার-চৌদ্দ ভাগের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়া দেখা দিতে পারে তবে সঠিক চিকিৎসায় এ রোগীরা সেরে উঠে, মাত্র ছয় ভাগের ক্ষেত্রে অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল হয় এবং এর মধ্যে আড়াই ভাগের মৃত্যু হতে পারে। তবে কোন দেশে আক্রমণ করছে, সেখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং আবহাওয়ার (তাপমাত্রা, আদ্রতা) উপর ভিত্তি করে মৃত্যুহার কম-বেশি হতে পারে। রোগীর বয়স ৬০ এর ওপরে হওয়া, অন্য কোন দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন উচ্চ-রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, কিডনির অসুখ আছে কিনা তার উপর ভিত্তি করে মৃত্যুহার কম-বেশি হতে পারে।
কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হলে কি কি লক্ষণ দেখা দেয়?
সারা বিশ্বের রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে ইউরোপের রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হলে কি কি লক্ষণ দেখা দেয় তার তালিকা দিয়েছে। তবে বয়স এবং অন্য কোন রোগ আছে কিনা, আক্রমণের কোন পর্যায়ে আছে তার উপর ভিত্তি করে লক্ষণ ভিন্ন হতে পারে।
লক্ষণগুলো হলঃ
• জ্বর (১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা এর উপরে, ৮৮% রোগীর ক্ষেত্রে জ্বর হতে দেখা গেছে)
• শুষ্ক কাশি (৬৮% রোগীর ক্ষেত্রে নতুন করে তৈরি হওয়া শুষ্ক কাশি হতে দেখা গেছে)
• অবসাদ/ক্লান্তি (৩৮% রোগীর ক্ষেত্রে রোগীরা খুব ক্লান্ত বা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে)
• শ্বাসকষ্ট (১৯% রোগীর ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়)
• গলাব্যাথা (১৪% রোগীর ক্ষেত্রে গলাব্যাথা দেখা দেয়)
• গায়ে ব্যাথা (১৫% রোগীর ক্ষেত্রে গা ব্যাথা দেখা দেয়)
• ডায়রিয়া/বমি (৪-৫% রোগীর ক্ষেত্রে ডায়রিয়া/বমি দেখা দেয়)
কভিড-১৯-এর লক্ষণ প্রকাশ পেতে কত সময় লাগে?
SARS-CoV-2 কোন মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ব্যাক্তিকে আক্রান্ত করতে সক্ষম হলে, এর লক্ষণ প্রকাশ পেতে নিম্নে ২ দিন থেকে ১৪ দিন এবং গড়ে ৫-৬ দিন সময় লাগে।
কভিড-১৯-এ আক্রান্ত নিশ্চিত হলে কি করতে হবে?
যেহেতু আশি ভাগ ক্ষেত্রেই এ রোগ কোন বিশেষ ওষুধ বা চিকিৎসা ছাড়া ভালো হয়ে যায় তাই হাসপাতালে ভর্তির দরকার পড়ে না। তবে, জ্বরের জন্য শুধুমাত্র প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে (দিনে চার বার ৫০০ মিলিগ্রাম করে)। অন্য ব্যথার ওষুধ ব্যাবহার করা নিরাপদ নয়। অসুস্থকালিন সময়ে বাসায় অবস্থান করতে হবে এবং শ্বাসকষ্ট হলে, বুকে চাপ অনুভব করলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
কভিড-১৯-এর সাথে সাধারণ ঠাণ্ডা-জ্বরের লক্ষণের পার্থক্য কি?
সমস্যা হল কভিড-১৯ এর লক্ষণের সাথে ফ্লু, সাধারণ ঠাণ্ডা-জ্বরের লক্ষণের অনেক মিল রয়েছে, তাই সাধারনভাবে বুঝা মুশকিল কোন ব্যাক্তি কভিড-১৯-এ আক্রান্ত কিনা। তবে, ফ্লু এবং সাধারণ ঠাণ্ডা-জ্বরের প্রধান পার্থক্য হল শ্বাসকষ্ট। ফ্লু এবং সাধারণ ঠাণ্ডা-জ্বরে শ্বাসকষ্ট হয় না। তাই উপরের লক্ষণগুলোর সাথে শ্বাসকষ্ট হলে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
কভিড-১৯ কিভাবে পরীক্ষা করা হয়?
কভিড-১৯ পরীক্ষা করার জন্য রোগীর নাকের ভিতর থেকে বা গলার কাছ থেকে সয়াব দিয়ে বা ফুসফুস থেকে বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয় এবং এ সব স্যাম্পলে কভিড-১৯ এর ভাইরাস আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে আরটি-পিসিআর (reverse transcriptase-polymerase chain reaction or RT-PCR) নামক এক বিশেষ ধরনের পদ্ধতি ব্যাবহার করতে হয়। রক্ত সংগ্রহ করেও রক্তে বিশেষ ধরণের অ্যান্টিবডির উপস্থিতি আছে কিনা তার মাধ্যমেও কভিড-১৯ সংক্রমণ ধরা পড়ে। তবে, রক্তের নমুনার চেয়ে নাক, গলা বা ফুসফুসের স্যাম্পল সঠিক ফলাফল দেয়। শুধু রক্তের টেস্ট করে সংক্রমণ নেই নিশ্চিত করা যাবে না।
কভিড-১৯-এর চিকিৎসা কি?
আশি ভাগ ক্ষেত্রে বাসায় বিশ্রাম এবং লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসায় রোগী সেরে উঠে। কিন্তু, অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। আক্রান্ত সন্দেহ হলে বাসায় আইসলেশনে থাকতে হবে। আলাদা ঘরে থাকতে হবে। সম্ভব হলে আলাদা বাথরুম ব্যাবহার করতে হবে। পরিবারের অন্য কেউ যাতে সংক্রমিত না হয় সেজন্য মাস্ক পড়তে হবে, এবং নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রাখতে হবে। রোগীর সেবাকারীরও মাস্ক পরা আবশ্যক। জ্বর কমাতে শুধুমাত্র প্যারাসিটামল ব্যাবহার করতে হবে।
প্রায় ১৩-১৫% রোগীর লক্ষণ মারাত্মক হতে পারে এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অক্সিজেন এবং স্যালাইন দেয়া লাগতে পারে। প্রায় পাঁচ ভাগ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত রোগীকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা লাগতে পারে। সঙ্কটাপন্ন রোগীদের জন্য চীন সহ কয়েকটি দেশে অন্য রোগে ব্যবহার করা কিছু ওষুধ কভিড-১৯ রোগে ব্যাবহার করে ভালো ফল পাওয়া গেছে যেমন ক্লোরোকুইন (২০০ মিগ্রা দিনে দুইবার চারদিন), টসিলিযুমাব (৪০০ মিগ্রা দিনে একবার ইন্ট্রাভেনাসলি) এবং ইন্ট্রাভেনাস রুটে বেশী মাত্রার ভিটামিন সি। কিউবার তৈরি নাকের মাধ্যমে প্রয়োগকৃত ওষুধ ইনটারফেরন-বি ভালো কাজ করছে বলে অনেক দেশ এটার আমাদানী শুরু করেছে।
কভিড-১৯ প্রতিরোধের উপায় কি?
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। যেকোন ভাইরাল অসুখ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা হল ভ্যাক্সিন। কিন্তু, এখনো কভিড-১৯-এর ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হয়নি। (১৭ মার্চ ২০২০) আমেরিকায় একটি ভাক্সিনের পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু হয়েছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সফল হলে বাজারে আসতে লেগে যেতে পারে কয়েক বছর।
করোনাভাইরাস হাঁচি-কাশি এবং সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়। তাই, কভিড-১৯ প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা (যেমন- ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধুয়া এবং হাত না ধুয়ে নাক মুখে হাত আন দেয়া), জনসমাগম এড়িয়ে চলা, খুব প্রয়োজন না হলে বাইরে না যাওয়া, গনপরিবহণ এড়িয়ে চলা, অসুস্থ্য মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা, বাড়িতে কেউ আক্রান্ত হলে আইসলেশনে রেখে মাস্ক পরে অসুস্থ্য ব্যাক্তির যত্ন নেয়া ইত্যাদির উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।
আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বেশী করে ফলমূল খাওয়া, খাবারে বেশী পরিমানে রসুন, আদা, পেঁয়াজ ব্যাবহার করা, হাল্কা গরম পানি খাওয়া, পর্যাপ্ত ঘুমানো, নিয়মিত শরীরচর্চা করা, মেডিটেশন করা, মাল্টিভিটামিন খাওয়া, ইয়গার্ট বা টক দই খাওয়া ইত্যাদির ব্যাপারে জোর দিচ্ছেন।
আসুন আতঙ্কিত না হয়ে, সবাই সচেতন হই। মানুষকে সচেতন করি এবং আল্লাহর রহমত কামনা করি।
ড. মোঃ আজিজুর রহমান,
সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসী বিভাগ,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।