নিয়ন্ত্রক কাঠামো কেবল আইন বা নিয়মের তালিকা নয়, বরং এটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য সঠিক কাঠামো, পরিবেশ বা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এই পরিবেশ বা ব্যবস্থা কিভাবে গড়ে উঠবে, তা নির্ভর করে নিয়ন্ত্রকদের দৃষ্টিভঙ্গি, ওই দেশের সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক কাঠামো, সংশ্লিষ্টদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, নৈতিকতা প্রভৃতির ওপর।
যেমন, নিয়ন্ত্রণ কাঠোমের মধ্যে কিছু দেশে খুব কড়াকড়িভাবে নির্ধারিত নিয়ম বা নির্দেশনামূলক পদ্ধতি (Prescriptive Approach) প্রতিপালন করতে হয়। নির্দেশনামূলক পদ্ধতিতে সাধারণত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের পরিধি সীমিত থাকে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকরা পরিচিত ঝুঁকিগুলোর জন্য পৃথক পৃথক নিয়ম প্রণয়নের চেষ্টা করেন। তবে এই পদ্ধতির একটি বড় সমস্যা হলো, দ্রুত পরিবর্তনশীল আর্থিক পরিবেশে এসব নিয়ম-কানুন অনেক সময় অচল হয়ে পড়ে এবং নতুন আর্থিক উদ্ভাবন থেকে সৃষ্ট ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়।
অন্যদিকে, বাজারকেন্দ্রিক পদ্ধতির (Market-Oriented Approach) নিয়ন্ত্রক কাঠামো এমন এক পদ্ধতি যেখানে বাজারের স্বাভাবিক নিয়মকে বিশ্বাস করা হয় এবং ধরে নেওয়া হয় যে বাজার নিজেই আর্থিক ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। ফলে বাজার পরিচালনা করার জন্য শুধু ন্যূনতম গাইডলাইন দেয়া হয়। অর্থাৎ সেখানে ব্যাংকগুলোকে বলা হয় তারা কিভাবে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করবে, সেটি তাদের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়।
ব্যাংকিং সম্পর্কিত বিধিনিষেধ যখন ব্যাংকগুলোর জন্য কঠোর ও নির্দেশনামূলক হয়ে ওঠে, তখন তাদের কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। ব্যাংকগুলো এসব কঠোর বিধিনিষেধের প্রভাব এড়াতে নতুন নতুন পণ্য ও সেবা উদ্ভাবন করে, যাতে তারা নিয়মের মধ্যে থেকেও কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। একে অনেক সময় “Regulatory Arbitrage” বলে, যেখানে ব্যাংকগুলো বিধিনিষেধের সীমাবদ্ধতাগুলো চতুরতার সঙ্গে এড়িয়ে যায়।
ধরা যাক, একটি দেশ ক্রেডিট কার্ড ঋণের সুদের হার ১০-১৫% নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো এতে মুনাফা কমে যাওয়ার ঝুঁকি দেখে। তখন তারা নতুন ধরনের ঋণ পণ্য চালু করতে পারে, যেমন ‘Buy Now Pay Later’ (BNPL – বিএনপিএল), যা কার্যত ঋণ দিলেও আনুষ্ঠানিকভাবে সেটি ক্রেডিট কার্ড ঋণের সংজ্ঞায় পড়ে না। এর ফলে, ব্যাংকগুলো কঠোর নিয়মের বাধা এড়িয়ে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে।
ব্যাংক তদারকির মূল কাজ শুধুমাত্র আইন মেনে চলা নিশ্চিত করা নয়, বরং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার গুণগত মান ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা, যাতে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থাটি সুদৃঢ় ও স্থিতিশীল থাকে। বিএনপিএল সাধারণত শূন্য শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ার মডেল অনুসরণ করে। তাহলে ব্যাংকের আয় কমে যাবার কমার কথা, তাই না? আসলে এখানে ব্যাংকের লাভের মূল কৌশলটি ভিন্নভাবে কাজ করে।
বিএনপিএল কিভাবে ব্যাংকের জন্য লাভজনক হতে পারে?
১) মার্চেন্ট (বিক্রেতা) ফি থেকে আয়: বিএনপিএল কোম্পানিগুলো সাধারণত বিক্রেতার (Merchant) কাছ থেকে ৩-৭% ফি নেয়। বিএনপিএল ব্যবস্থায় গ্রাহকরা বেশি খরচ করে (অর্থাৎ মার্চেন্টের বিক্রি বেড়ে যায়), যা বিক্রেতার জন্য লাভজনক। ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার কমিয়ে দিলে ব্যাংকের আয় কমবে, কিন্তু বিএনপিএলের মাধ্যমে ব্যাংক বিক্রেতাদের কাছ থেকে এই ফি আদায় করতে পারে।
২) লেট ফি ও অন্যান্য চার্জ: বিএনপিএল ব্যবহারকারীদের অনেক সময় নির্দিষ্ট কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করতে না পারলে লেট ফি দিতে হয়, যা ব্যাংকের জন্য একটি আয় উৎস। আবার কোনো কোনো বিএনপিএল কোম্পানি নির্দিষ্ট সময়ের পর সুদ বা সার্ভিস চার্জ আরোপ করে।
৩) অন্য পণ্য বিক্রির সুযোগ সৃষ্টি: বিএনপিএল ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাংক বা ফিনটেক কোম্পানিগুলো গ্রাহকের কেনাকাটার ধরন ও লেনদেনের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে, যা ভবিষ্যতে অন্যান্য আর্থিক পণ্য বিক্রির জন্য ব্যবহার করা যায়।
৪) দীর্ঘমেয়াদে সুদযুক্ত ঋণে রূপান্তর: কিছু বিএনপিএল স্কিম প্রথমদিকে শূন্য সুদে ঋণ দিলেও, পরে দীর্ঘমেয়াদি কিস্তির ক্ষেত্রে সুদের হার আরোপ করে। ফলে ব্যাংকের জন্য এটি লাভজনক হয়ে ওঠে।
বিএনপিএলের বিকল্প ঋণব্যবস্থা
বিএনপিএলের মতো কিছু বিকল্প ঋণপদ্ধতি রয়েছে, যা ব্যাংকগুলো কঠোর নিয়ন্ত্রক বিধিনিষেধ এড়িয়ে নতুনভাবে আয় বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করতে পারে। এগুলো মূলত “বিকল্প ঋণ মডেল” নামে পরিচিত। বিকল্প ঋণব্যবস্থা হল—
১. মার্চেন্ট পেমেন্ট প্ল্যান বা পিওএস ফাইন্যান্সিং: এটি বিএনপিএলের মতোই, কিন্তু পুরোপুরি ব্যাংকের আওতায় থাকে না। মার্চেন্ট বা বিক্রেতারা নিজস্ব কিস্তি সুবিধা প্রদান করে এবং ব্যাংক বা ফিনটেক প্রতিষ্ঠান তা অর্থায়ন করে। আয় উৎস: মার্চেন্ট ফি + লেট ফি + সার্ভিস চার্জ।
২. রিভলভিং ক্রেডিট লাইন: এটি ক্রেডিট কার্ডের মতোই কিন্তু আলাদা পণ্যের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এখানে গ্রাহককে নির্দিষ্ট লিমিট দেওয়া হয় এবং তারা প্রয়োজনমতো টাকা ব্যবহার করতে পারে। ক্রেডিট কার্ডের চেয়ে বেশি গ্রাহকবান্ধব শর্ত দেওয়া হয়, তাই এটি সহজেই গ্রহণযোগ্য হয়। আয় উৎস: সুদ + বার্ষিক ফি + নগদ উত্তোলনের চার্জ।
৩. স্যালারি অ্যাডভান্স বা আর্নড ওয়েজ অ্যাক্সেস: ব্যাংক বা ফিনটেক কোম্পানি গ্রাহকদের তাদের উপার্জিত কিন্তু এখনও পাওয়া যায়নি এমন বেতনের বিপরীতে ঋণ দেয়। সাধারণত সুদের বদলে ফিক্সড সার্ভিস চার্জ নেওয়া হয়। আয় উৎস: লেনদেন ফি বা সাবস্ক্রিপশন ফি।
৪. ইএমআই ভিত্তিক ঋণ: এটি সরাসরি বিএনপিএলের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে, যেখানে ব্যাংক নির্দিষ্ট পণ্যের জন্য সহজ শর্তে কিস্তির সুবিধা দেয়। অনেক সময় সুদ কমিয়ে কিস্তির মাধ্যমে আয় করা হয়। আয় উৎস: সুদ + প্রসেসিং ফি + লেট ফি।
৫. স্থগিত সুদ ভিত্তিক ঋণ: গ্রাহককে শূন্য সুদে ঋণ দেওয়া হয়, কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পার হলে সুদ আরোপ করা হয়। এটি মূলত বিএনপিএলের আরও দীর্ঘমেয়াদি সংস্করণ। আয় উৎস: সুদ + লেট ফি।
৬. সাবস্ক্রিপশন ভিত্তিক ঋণ: ব্যাংক বা ফিনটেক কোম্পানি নির্দিষ্ট মাসিক ফি নিয়ে স্বল্প পরিমাণ ঋণ বা ক্রেডিট লাইন অফার করে। এতে গ্রাহককে সুদ দিতে হয় না, কিন্তু প্রতি মাসে ফি দিতে হয়। আয় উৎস: সাবস্ক্রিপশন ফি।
এ ধরনের বিকল্প ঋণপদ্ধতি সরাসরি প্রথাগত ঋণের (যেমন পার্সোনাল লোন, ক্রেডিট কার্ড, কিংবা টার্ম লোন) মতো সুদের ওপর নির্ভর করে না। তবে এটি নির্ভর করে ডিজিটাল সক্ষমতা এবং সঠিকভাবে ডিজাইন করা ব্যবসায়িক মডেলের উপর। যা কার্যকর হলে ব্যাংকগুলোর জন্য প্রথাগত ঋণের তুলনায় সমান বা বেশি আয় নিশ্চিত করতে পারে।
কিভাবে এই মডেলগুলো ব্যাংকের আয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারে?
একাধিক আয় উৎস: প্রথাগত ঋণ কেবল সুদের ওপর নির্ভর করে, কিন্তু বিএনপিএল ও অন্যান্য বিকল্প ঋণমডেল সুদ, লেনদেন ফি, মার্চেন্ট ফি, লেট ফি এবং সাবস্ক্রিপশন ফি ইত্যাদির সমন্বয়ে আয়ের সুযোগ করে দেয়। উদাহরণ: প্রথাগত ক্রেডিট কার্ড: ১০-১৫% সুদের হার + কিছু প্রসেসিং ফি। বিএনপিএল/পিওএস ফাইন্যান্সিং: ৫-৭% মার্চেন্ট ফি + কিছু সুদ/লেট ফি + প্রসেসিং ফি। সাবস্ক্রিপশন ঋণ: প্রতি মাসে নির্দিষ্ট ফি + লেট ফি + অন্যান্য সার্ভিস চার্জ।
উচ্চ লেনদেনের হার: বিএনপিএল/পিওএস ফাইন্যান্সিংয়ের মতো মডেলগুলি গ্রাহকের জন্য অনেক সহজ এবং দ্রুত অ্যাক্সেসযোগ্য। ক্রেডিট কার্ডের তুলনায় বিএনপিএল ২-৩ গুণ বেশি ব্যবহৃত হয়, কারণ এটি জটিল আবেদন প্রক্রিয়া ছাড়া পাওয়া যায়। ব্যাংক কম সুদ নিলেও বেশি লেনদেনের মাধ্যমে মোট আয় ধরে রাখতে পারে।
খেলাপি কম হবার ঝুঁকি: প্রথাগত ব্যক্তিগত ঋণের খেলাপি হার তুলনামূলক বেশি, কারণ এটি সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি এবং বড় অঙ্কের ঋণ। বিএনপিএল বা আর্নড ওয়েজ অ্যাক্সেসের মতো ক্ষুদ্র ঋণ স্বল্প মেয়াদের হওয়ায় খেলাপি হবার সম্ভাবনা কম, যা ব্যাংকের মূলধন সুরক্ষা দেয়। যেখানে একটি পার্সোনাল লোন ১২-২৪ মাসের জন্য নেওয়া হয়, সেখানে বিএনপিএলের মেয়াদ ৩-৬ মাস, ফলে খেলাপি হওয়ার সুযোগ কম।
অন্যান্য পণ্য বিক্রির সুযোগ: উপরে বর্ণিত ঋণগুলোর মাধ্যমে গ্রাহকদের ব্যাংকের ইকোসিস্টেমে ধরে রাখা যায়। গ্রাহক একবার বিএনপিএল ব্যবহার করলে, ভবিষ্যতে তাকে পার্সোনাল লোন বা অন্যান্য ব্যাংকিং সেবায় আকৃষ্ট করা সহজ হয়।
গ্রাহক ধরে রাখার সুযোগ: কম সুদ বা ফি ভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থা থাকায় গ্রাহক সহজে প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানে চলে যায় না। প্রথাগত ঋণে উচ্চ সুদের কারণে অনেক গ্রাহক ঋণ পরিশোধের পর ব্যাংক পরিবর্তন করে, কিন্তু বিএনপিএল বা সাবস্ক্রিপশন ভিত্তিক ঋণে গ্রাহক দীর্ঘমেয়াদে যুক্ত থাকে।
এই বিকল্প ঋণব্যবস্থাগুলো যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তবে ব্যাংকগুলো মোট আয়ের দিক থেকে প্রথাগত ঋণের সমান বা বেশি লাভ করতে পারে। আয় নিশ্চিত করতে হলে ব্যাংকগুলোকে শুধু সুদের ওপর নির্ভর না করে অন্যান্য ফি ও চার্জিং মডেলের ওপর ফোকাস করতে হবে। ট্রানজেকশন ভলিউম বৃদ্ধি, কম খেলাপি হার ও গ্রাহক ধরে রাখার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে বেশি মুনাফা করা সম্ভব।
লেখক : মো. সাইফুল আলম তালুকদার
রিটেইল ব্যাংকার
বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি