পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা বাড়াতে চায় বাংলাদেশ

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরালো নয়। গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠতে পারেনি পাকিস্তান। তবে  বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য পাকিস্তানের অনুকূলে। বাংলাদেশ সেখান থেকে তুলা, সুতা, কাপড় ও প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়লে বাংলাদেশ উপকৃত হবে। কারণ ব্যবসায়ীরা সেখান থেকে আরও প্রতিযোগিতামূলক দামে কাঁচামাল কেনার ব্যাপারে আশাবাদী।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে—চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রতিবেশী পাকিস্তানে রপ্তানি করেছে তিন ৩৯ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন ডলার।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাকিস্তানে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৬১ দশমিক ৯৮ মিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের রপ্তানি ৮৩ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৩১ দশমিক ৭৮ শতাংশ কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে—চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের আমদানি ছিল ৩৭২ দশমিক এক মিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাকিস্তান থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ৬২৭ দশমিক আট মিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৬৯৮ দশমিক সাত মিলিয়ন ডলার।

দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশীর মধ্যে আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও দুর্বল বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠেনি।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীন থেকে আমদানি করেছিল ১৬ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। দেশটির মোট আমদানির ২৬ দশমিক চার শতাংশ। একই বছর ভারত থেকে আমদানি করা হয় নয় বিলিয়ন ডলার। এটি বাংলাদেশের মোট আমদানির ১৪ দশমিক তিন শতাংশ।

বিপরীতে, পাকিস্তান থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ৬২৭ দশমিক আট মিলিয়ন ডলার। এটি বাংলাদেশের মোট আমদানির এক শতাংশ। পাকিস্তান বাংলাদেশের ২০তম বৃহত্তম আমদানি অংশীদার।

এর বেশিরভাগ অর্থাৎ ৪৭৬ দশমিক তিন মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে তুলা আমদানিতে।

রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের খাদ্য ও জ্বালানিসহ প্রধান পণ্যগুলোর নির্ভরযোগ্য, প্রতিযোগিতামূলক ও নতুন নতুন উৎস দরকার। পণ্য সরবরাহকারী দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় পাকিস্তান এখন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে পারে। দুই সরকারের মধ্যে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সেগুলো যৌক্তিক হওয়া উচিত।

স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) আওতায় পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সুবিধা থাকলেও রপ্তানির পরিমাণ কম হওয়ায় বাংলাদেশ লাভবান হতে পারছে না।

পাকিস্তানের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আশু প্রয়োজন দেখছেন না আব্দুর রাজ্জাক। তার ভাষ্য—বড় বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে অবদান রাখতে পারে।

বর্তমানে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য দক্ষিণ এশিয়ার মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের পাঁচ শতাংশেরও কম।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে গত ১৫ বছর ধরে প্রায় স্থবির হয়ে থাকা বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করা হলে বাংলাদেশ লাভবান হবে।

প্রতিযোগিতামূলক দামকে মূল বিষয় হিসেবে তুলে ধরে আবুল কাসেম বলেন, এটি ব্যবসার জন্য ইতিবাচক হবে। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতামূলক দামে পাকিস্তানি সুতি কাপড় ও ডেনিম কিনতে পারে।

একই মত ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেনেরও।

পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়লে বাংলাদেশ কাঁচামালের জন্য আরও বিকল্প পাবে। বাংলাদেশ পাকিস্তানে পাট ও চা রপ্তানি বাড়াতে পারে।

তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, ২০০৫ সালে তিনি এফবিসিসিআই সভাপতি থাকাকালে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আলোচনা গতি পেয়েছিল। পরে তা স্থগিত হয়ে যায়।

পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) প্রস্তাব ২০০২ সালে প্রথম দেওয়া হয়। ২০০৪ সালের সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে তা নিয়ে আবার আলোচনা হয়। তবে বাংলাদেশি পণ্যের একতরফা ও নিঃশর্ত প্রবেশাধিকারের অনুরোধ পাকিস্তান গ্রহণ না করায় তা চূড়ান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাজার বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান দ্য আটলান্টিক কাউন্সিল।

করাচির পাকিস্তান বিজনেস কাউন্সিল (পিবিসি) ২০২২ সালে ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট অপরচুনিটিজ ইন অ্যা পাকিস্তান-বাংলাদেশ ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (এফটিএ)’ শীর্ষক গবেষণা পরিচালনা করে।

প্রতিবেদনে পাকিস্তানের পক্ষে দীর্ঘদিনের বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতার বিষয়টি তুলে ধরা হয়।

২০১১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানের রপ্তানি ছিল ৯৪৭ দশমিক ২৩ মিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে কমে হয় ৫৮৩ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন ডলার। তখন বাংলাদেশ থেকে আমদানি হয়েছিল ৮২ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে তা কমে হয় ৬১ দশমিক ৯৪ মিলিয়ন ডলার।

২০২০ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল ৫২১ দশমিক পাঁচ মিলিয়ন ডলার। এটি গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।

পিবিসির বিশ্লেষণ অনুসারে, বাংলাদেশে পাকিস্তানের দুই দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারের বস্ত্র, কৃষি, খাদ্যদ্রব্য, রাসায়নিক, বেইজ মেটাল, প্লাস্টিক ও সিমেন্ট রপ্তানির সম্ভাবনা আছে।

বিশ্লেষণ অনুসারে, ২০২০ সালে শীর্ষ ২৫ পণ্যের আনুমানিক রপ্তানির সম্ভাবনা ছিল এক দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। অথচ পাকিস্তানের এই পণ্যগুলোর প্রকৃত রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৩৫ দশমিক ৭৮ মিলিয়ন ডলার।

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য জোরদার করতে গত ১৩ জানুয়ারি পাকিস্তান-বাংলাদেশ জয়েন্ট বিজনেস কাউন্সিল (পিবিজেবিসি) গঠনে ফেডারেশন অব পাকিস্তান চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ও এফবিসিসিআই সমঝোতা স্মারক সই করে।

যৌথ বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেওয়া এফবিসিসিআই প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনার কথা স্বীকার করেছেন।

তবে তিনি উল্লেখ করেছেন যে সম্ভবত রাজনৈতিক কারণে বাণিজ্যের পরিমাণ কম।

দুর্বল যোগাযোগকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘সরাসরি জাহাজ চলাচলের অভাব ও ভিসা জটিলতার কারণে অতীতে বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হয়েছে।’

এখন বাংলাদেশিদের জন্য পাকিস্তান ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করে আবেদনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা অনুমোদন দিয়েছে।

দুই দেশের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

তুলা, সুতা ও কাপড়ের জন্য পাকিস্তানকে উৎস হিসেবে উল্লেখ করে মো. হাফিজুর রহমান আরও বলেন, স্থানীয় বস্ত্র ও পোশাক কারখানাগুলো কয়েক বছর ধরে কাঁচামাল সংগ্রহে বৈচিত্র্য এনেছে। পাকিস্তান বেশ কয়েকটি মূল সরবরাহকারীদের মধ্যে একটি হয়ে উঠেছে।

তিনি জানান—বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এখন আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশ থেকে তুলা আমদানি করছেন।
প্রতিযোগিতামূলক দামের কারণে বাংলাদেশের তুলা ব্যবসায়ীরা পাকিস্তান থেকে বেশি তুলা আমদানি করছেন, উল্লেখ করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, পাকিস্তানি রুপির ব্যাপক অবমূল্যায়নের কারণে পাকিস্তানি তুলা এখন অনেক সস্তা। আগে দুর্বল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কারণে পাকিস্তান থেকে প্রচুর পরিমাণে পণ্য আমদানি সীমিত ছিল। তবে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি পণ্য আমদানির প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.