রোজা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা- সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য

রোজা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা- সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য

রোজা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা- সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য

রোজা ইসলামের একটি মৌলিক ইবাদত, যা শুধু ধর্মীয় বিধানই নয়, বরং শারীরিক ও মানসিক সুস্থতারও একটি উপায়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রোজা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, যা রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আজ আমরা রোজা নিয়ে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা ও তার সত্যতা নিয়ে আলোচনা করব।

রোজা শরীরকে দুর্বল করে দেয়

ভুল ধারণা- অনেকের ধারণা, রোজা রাখলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, শক্তি কমে যায় এবং অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে যারা শারীরিকভাবে দুর্বল মনে করেন, তারা রোজা রাখতে ভয় পান।
সত্য- বাস্তবে রোজা শরীরের এনার্জি লেভেল বাড়ায়। বিজ্ঞান বলছে, দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং উপকারী। আমাদের দেহে আইজিএফ-১ নামক একটি গ্রোথ হরমোন থাকে, যা অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের ফলে বেশি উৎপন্ন হয়। এই হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলে ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়ে। রোজা রাখলে এই হরমোনের মাত্রা কমে, যা শরীরের জন্য উপকারী।

২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. ইয়োশিনারি ওশুমি প্রমাণ করেছেন যে, রোজা রাখলে শরীরে “অটোফেজি” প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়। এই প্রক্রিয়ায় শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলো মেরামত হয় এবং নতুন শক্তি উৎপন্ন হয়। তাই রোজা শরীরকে দুর্বল না করে বরং আরও শক্তিশালী করে।

সেহরিতে বেশি খেতে হবে

ভুল ধারণা-অনেকেই মনে করেন, সেহরিতে যত বেশি খাওয়া যায়, তত ভালো। তারা ভূরিভোজের আয়োজন করেন, যাতে সারাদিন রোজা রাখতে কোনো সমস্যা না হয়।
সত্য- সেহরিতে অতিরিক্ত খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর। প্রোটিন ও চর্বিজাতীয় খাবার হজম করতে শরীরের বেশি পানি প্রয়োজন হয়, যা রোজার সময় পাওয়া যায় না। ফলে তৃষ্ণা ও অস্বস্তি বেড়ে যায়। বরং সেহরিতে হালকা ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত, যা সারাদিন শরীরকে সতেজ রাখবে।
১০৫ বছর বয়সী ম্যারাথন দৌড়বিদ ফৌজা সিংয়ের উদাহরণ থেকে আমরা শিখতে পারি। তিনি দিনে অল্প পরিমাণে খেতেন, কিন্তু তার খাবার ছিল পুষ্টিকর ও সহজপাচ্য। এটাই তাকে সুস্থ ও প্রাণবন্ত রাখতে সাহায্য করেছে।

ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য রোজা ক্ষতিকর

ভুল ধারণা-ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়মিত খাবার খেতে হয় বলে অনেকেই মনে করেন, রোজা রাখা তাদের জন্য বিপজ্জনক।
সত্য- গবেষণা বলছে, রোজা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং উপকারী হতে পারে। ডায়াবেটিসের মূল কারণ হলো ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, যা অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে তৈরি হয়। রোজা রাখলে ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং কোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। তবে ডায়াবেটিস রোগীদের রোজা রাখার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

আলসার থাকলে রোজা রাখা যায় না

ভুল ধারণা- আলসার রোগীদের ধারণা, রোজা রাখলে তাদের আলসার বেড়ে যাবে।
সত্য-পেপটিক আলসারের ক্ষেত্রে রোজা রাখা উপকারী হতে পারে। রোজার সময় পাকস্থলীতে অ্যাসিড নিঃসরণ কমে যায়, যা আলসারের ব্যথা ও জ্বালাপোড়া কমাতে সাহায্য করে। তবে আলসার রোগীদের রোজা রাখার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

রোজার মাসে খাবারের কোনো হিসাব নেই

ভুল ধারণা- অনেকের ধারণা, রোজার মাসে ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত যা ইচ্ছা খাওয়া যায়, কোনো সংযমের প্রয়োজন নেই।
সত্য- রোজার মূল উদ্দেশ্য হলো সংযম। রমজান মাসে খাদ্যাভ্যাসে সংযম পালন করা উচিত। কিন্তু বর্তমানে রমজান মাসে আমরা বেশি খাওয়া শুরু করি, যা রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্যের বিপরীত। ইফতার ও সেহরিতে ভারী ও অতিরিক্ত খাবার খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বরং রোজার সময় হালকা ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত।

ইফতার ও সেহরি পার্টি

ভুল ধারণা-ইফতার ও সেহরি পার্টি করা এখন একটি ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, এটি রোজার একটি অংশ।
সত্য- রোজার প্রকৃত শিক্ষা হলো সংযম ও সহজ জীবনযাপন। নবীজি (সা.) ইফতার করতেন খুব সাধারণভাবে – তাজা খেজুর বা পানি দিয়ে। কিন্তু আজ আমরা ইফতার ও সেহরিতে বিলাসিতা করছি, যা রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক। ইফতার ও সেহরি পার্টি করা রোজার শিক্ষার বিপরীত।

রোজা শুধু একটি ধর্মীয় বিধানই নয়, এটি শরীর, মন ও আত্মার জন্য একটি সুস্থতা প্রক্রিয়া। রোজা নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো পরিহার করে এর প্রকৃত শিক্ষা ও উপকারিতা অনুসরণ করা উচিত। রোজার মাধ্যমে আমরা শারীরিক সুস্থতা, মানসিক প্রশান্তি ও আত্মিক উন্নতি লাভ করতে পারি, যদি সঠিকভাবে এর অনুশীলন করি।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.