জলের জঞ্জাল কচুরিপনায় ‘শিল্প’ যাচ্ছে বিদেশেও
ধ্বংস করো এই কচুরিপানা, এরা লতা নয় পরদেশি অসুর ছানা! কচুরিপানা নিয়ে এই কবিতাটি লিখেছেন স্বয়ং কবি নজরুল। নিজের সবটুকু বিষাদ ঢেলেছেন তাতে। আবার বন্দে আলী মিয়া কচুরিপানায় মুগ্ধ হয়ে দিয়েছেন শব্দের নিপুণ গাঁথুনি। একসময় বাংলার অর্থনীতিতে দুর্দশা ডেকে এনেছিল জলাশয়ে ভাসমান কচুরিপানা। এমন কী এটি নির্মূলের জন্য ইংরেজদের কাছে নালিশও দেয় কৃষক। তবে সময়ের বিবর্তনে এই জলজ জঞ্জাল এখন হয়ে উঠেছে শিল্প, যাচ্ছে অন্য দেশে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা।
কচুরিপানা বহুবর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। কিন্তু এর সৌন্দর্যের অন্তরালে আছে হুংকার। তাই একে বলা হয় বিউটিফুল ব্লু ডেভিল। এর লাগামহীন বিস্তারে আবদ্ধ ছিল গোটা নৌপথ। অবাক করা তথ্য হলো এটির প্রভাব দমাতে ইংরেজদের কাছে নালিশও দেয় কৃষকরা। এমনকি এটি নির্মূলে কমিটিও গঠন হয়। যার নেতৃত্বে ছিলেন স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু।
কচুরিপানা সংশয়ে ফেলে দেয় গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে। সেসময় এটি দেশের অর্থনীতিকে প্রায় অচল করে দিয়েছিল। তাই ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে এটি স্থান পায়। কচুরিপানা মুক্ত বাংলা গড়ারও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
উদ্ভিদটির ক্ষিপ্রবেগ ঠেকাতে নিমজ্জিত হয় সব পদক্ষেপ। এখন অবশ্য বদলে গেছে এর সুরতহাল। ভোল পালটে কচুরিপানায় ভর করে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। সময়ের পালাবদলে রূপান্তর ঘটেছে এর চাহিদায়।
ময়ূরের পালকের মতো দেখতে এর ফুল। যার মোহনীয় রূপে আকৃষ্ট হয়ে ১৮ শতকের শেষদিকে কোনো এক বণিক বা পর্যটক এটিকে বাংলার জলাশয়ে আসেন। অথচ ১৯২০ সালের মধ্যেই দেশের প্রতিটি জলাধার দখলে নিয়ে নেয় এটি। অর্থাৎ জ্যামিতিক হারে এটি বিস্তার ঘটায়। মূলত কচুরিপানার আদি নিবাস গহীনতম অ্যামাজন ফরেস্ট।
এটি হয়ে উঠেছে দেশের অন্যতম কুটির শিল্প। যার উপর ঝুলে আছে লাখো মানুষের ভাগ্য। ময়লার ভাগাড়ের কচুরিপানা এখন ঘরের শোভা। এটি দিয়ে তৈরি হচ্ছে ঝুড়ি, হ্যান্ডব্যাগ, ফুলের টব, ফলদানি, জুতা, ম্যাটসহ নানা প্রসাধনী।
সুদূর ইউরোপে এর বিশেষ চাহিদা রয়েছে। তাই রপ্তানি মূল্যও অনেক। যা ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে দেশের জিডিপিতে। কচুরিপানায় ভর করে অনেকেই হয়েছেন স্বাবলম্বী।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন পরিবেশ রক্ষায় প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে এর ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। আবার শুকনো কচুরিপানা যেন গরিবের জ্বালানি বন্ধু। জৈবিক সার হিসেবেও এটিতে কৃষকের আস্থা। যা বীজ উৎপাদনে অনেক কার্যকরী। সবশেষ গো-খাদ্যেরও অন্যতম উপাদান এই জলজ উদ্ভিদটি।