বাড়তি শুল্ক: রোজার আগেই অস্থির ফলের বাজার
দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র রমজান। রমজানে ফলের চাহিদা বাড়ে কয়েকগুন। কিন্তু এবার রমজান শুরুর আগেই অস্থির হয়ে উঠেছে ফলের বাজার। আপেল, কমলা, মাল্টা, আঙুরসহ প্রায় সব ধরনের বিদেশি ফলের দাম পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে কেজিপ্রতি ২০-৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এতে এসব ফলের বিক্রি প্রায় অর্ধেক কমে গেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্ক বাড়ানোর ফলে অনেকটাই দামি পণ্যে পরিণত হয়েছে ফল। কমলা, আপেল, আঙ্গুরের দাম বৃদ্ধিতে দেশি জাতের ফলের দিকে ঝুঁকছেন অনেকে। কিন্তু সেখানেও স্বস্তি নেই। এমন পরিস্থতিতে, ফল আমদানিতে আরোপিত শুল্ক-কর কমানোর পক্ষে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। শুল্ককর কমাতে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন।
গত ৯ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) শুকনো ও টাটকা ফল আমদানির ওপর সম্পূরক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করেছে। আপেল, আঙুর ও তরমুজের মতো কিছু টাটকা ফল ও জুসের ওপর শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। এর প্রভাবেই বাজারে বেড়ে যায় সব ধরনের ফলের দাম।
রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার বাদামতলীতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফুজি আপেল প্রতি কার্টনের দাম (১৯-২০ কেজি) বেড়ে ৫ হাজার ৪০০ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া যে আঙুর প্রতি কার্টন (৯ কেজি) দাম ছিল ৪ হাজার ৫০০ টাকা, তা বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার টাকায়। কমলার দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ভারত থেকে আমদানি করা কমলাও ৫ হাজার ৪০০ টাকায় উঠেছে। চায়না কমলা ৩ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাল্টা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কার্টন (১৪-১৫ কেজি) ৩ হাজার ৫০০ টাকা, যা আগে ছিল ৩ হাজার ১০০ টাকা।
ফলের দাম এভাবে বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে ভিটামিনের ঘাটতি পূরণে এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে এত দিন যারা ফল খেতেন, তাদের সামর্থ্যে টান পড়েছে। হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকে ফল কেনা বন্ধ করেছেন, অনেকে পরিমাণে কম কিনছেন। এতে ফলের বিক্রি ৫০ শতাংশ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি করা ফলের বাজারে যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা বসিয়েছে সরকার। ২০২২ সালে মে মাসে আমদানি করা ফলকে বিলাস পণ্য ঘোষণা দিয়ে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও করের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসায় সরকার। এবার সেই শুল্ক আরেক দফা বাড়ানো হলো। এই সিদ্ধান্তের ফলে আমদানি করা ফল বন্দর থেকে খালাস করতে আগের তুলনায় কেজিতে ৪৫ টাকা পর্যন্ত বাড়তি খরচ হচ্ছে। এতে দামও বাড়াতে হচ্ছে। দাম বাড়ার কারণে বিক্রি কমে যাওয়ার পচনশীল পণ্য ফলের মজুত নিয়ে বিপাকে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। বিক্রি না হওয়ার ভয়ে অনেকে আমদানি বন্ধ করে দিচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে আগামী রমজান মাসে দেশে চাহিদার বিপরীতে ফলের সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেবে।
আমদানিকারকেরা জানিয়েছেন, রমজানকে সামনে রেখে এনবিআরের কাছে তাঁদের দাবি ছিল যাতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, আমদানি শুল্ক ও অগ্রিম কর—সব মিলিয়ে অন্তত ৩০ শতাংশ কর ছাড় দেওয়া হোক। রমজানে যেহেতু দেশীয় ফলের কোনো মৌসুম থাকবে না, তাই শুল্ক ছাড় দিলে আমদানি করা ফল রমজানের চাহিদা পূরণ করতে পারত। কিন্তু সরকার উল্টো শুল্ক আরও বাড়িয়েছে।
নতুন করে শুল্ক বাড়ানোর ফলে প্রতি কেজি আপেল, কমলা ও মাল্টায় শুল্ক বেড়েছে ১৬ টাকা ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে তা ২০ টাকার বেশি হয়। এ ছাড়া আঙুর ও আনারে বেড়েছে ২৫-৩০ টাকা।
সিরাজুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, গরিব মানুষের কথা চিন্তা করে আমরা মাসখানেক আগে শুল্ক কমানোর জন্য রাজস্ব বোর্ডে চিঠি দিয়েছিলাম। যাতে রমজানে ফলের দামটা কম থাকে। কিন্তু সরকার উল্টো দাম আরও বাড়াল। এই সিদ্ধান্তের কারণে অনেক আমদানিকারকই লোকসানে পড়েছেন। এমন অবস্থায় নতুন করে ফল আমদানিতে সাহস পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। এর প্রভাব রমজানে অবশ্যই পড়বে।
খাদ্যপণ্য হওয়া সত্ত্বেও বিদেশি ফলকে ২০১২ সালে বিলাস পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এই সিদ্ধান্তের পর প্রতিবছর বাজেটে আমদানি ফলের ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানো হয়। ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত আমদানি করা সব ধরনের ফলে ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি (আমদানি শুল্ক), ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর এবং ৪ শতাংশ অ্যাডভান্স ট্রেড ভ্যাট ছিল।
বাংলাদেশে ডলার-সংকটের মধ্যে গত বছরের মে মাসে সব ধরনের বিদেশি ফল আমদানিতে নতুন করে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বা রেগুলেটরি ডিউটি আরোপ করেছিল এনবিআর। তাতে সব মিলিয়ে ফল আমদানিতে শুল্ক-কর বেড়ে দাঁড়ায় ১১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। দুই বছরের মধ্যে আবারও শুল্ক ১০-১৫ শতাংশ বাড়ানো হলো।
আমদানিতে ব্যয় বাড়ার প্রভাব ইতিমধ্যে খুচরায়ও পড়েছে। রাজধানীর রামপুরা বাজারে প্রতি কেজি আপেল (ফুজি) বিক্রি হয়েছে ৩০০ টাকায়, যা চার-পাঁচ দিন আগে ছিল ২৮০ টাকা। ভারতীয় কমলা বিক্রি হয়েছে ২৮০–২৯০ টাকা কেজি, আগে যা ছিল ২৬০–২৭০ টাকা কেজি। মাল্টা বিক্রি হয়েছে ২৮০ টাকা কেজি, যা আগে ছিল ২৬০ টাকা কেজি। চায়না কমলা বিক্রি হয়েছে ৩৫০ টাকা কেজি, যা ছিল ৩২০ টাকা কেজি। কালো আঙুর ৫৫০ টাকা, আগে ছিল ৫০০ টাকা কেজি। সাদা আঙুর ৪৬০ টাকা, আগে ছিল ৪০০ টাকা কেজি এবং লাল আঙুর ৬০০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে, যা আগে ছিল ৫০০ টাকা কেজি।
ফল বিক্রেতা মো. রুবেল বলেন, ‘ফলের পাইকারি বাজারে দাম বাড়লে আমাদেরও বাড়তি দামে বিক্রি করতে হয়। তবে দাম বাড়লে আমার জন্যও ক্ষতি। কারণ প্রতিবার দাম বাড়লেই বিক্রি কমে যায়। মানুষ প্রতিদিনের খাবার খেয়ে ও অন্যান্য খরচ দিয়ে যে বাড়তি টাকা থাকে, তা দিয়ে ফল কিনে খায়। এখন সব জিনিসের দাম বেড়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এমনিতেই কমে গেছে, আবার ফলের দাম বাড়ায় আমাদের বিক্রি প্রায় অর্ধেকে নেমেছে।’
রাজধানীর সেগুনবাগিচা বাজারের ক্রেতা মাহবুব আলম বলেন, সারা বছরই এখন ডেঙ্গুসহ নানা রোগ-বালাই লেগে রয়েছে, যার জন্য ফল একধরনের পথ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। দাম বাড়ার পর অনেকেই ফলের ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। আগামী রমজানে অনেক মানুষকে ফল ছাড়াই ইফতার করতে হবে। কারণ তখন দেশি ফলের কোনো মৌসুম নেই। এতে অনেক রোজাদার ভিটামিনের ঘাটতিতে পড়বেন।