ঢাকা গণপরিবহন: অনিয়মই যেখানে নিয়ম
রাজধানী ঢাকায় রোজকার যাতায়াতে পরিবহন বলতে ভরসা জরাজীর্ণ লোকাল বাস। নগরীতে চলার পথে যার আরেক নাম ভোগান্তি। নিয়মের তোয়াক্কা না করে ছুটে চলাই এখানে নিয়ম। বেপরোয়া গাড়ি চালানো, চালক-হেলপারদের দৌরাত্ম্য আর অনিয়ম গণপরিবহনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। যা থেকে নিস্তার নেই সাধারণ যাত্রীদের। যেন অনিয়ম আর নৈরাজ্যের বেড়াজালে রাজধানীর গণপরিবহন।
যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা, অসুস্থ প্রতিযোগিতায় অতিষ্ঠ সাধারণ যাত্রীরা। আছে ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’য়ের মতো ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দৌরাত্ম্য। পরিবহন মালিকদের দাবি, মালিক-শ্রমিকের দ্বন্দ্বে কার্যকর করা যাচ্ছে না সরকারি উদ্যোগ। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরনো সংস্কৃতি বদলে গণপরিবহন ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে।
রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে গাড়ি থামানো নিষেধ। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন কোম্পানির বাস যানজট সৃষ্টি করে যাত্রী তোলায় ব্যস্ত। দেখেও দেখার কেউ নেই। নিরুপায় যাত্রীরা।
পুরান ঢাকার জনসন রোডে এভাবেই সড়ক আটকে যানজটের সৃষ্টি করে বিভিন্ন কোম্পানির বাস। ছবি: সংগৃহীত
যাত্রীদের একজন বলেন, ‘একদমই সন্তুষ্ট না আমরা। যানজট বেড়ে গেছে।’
আরেকজন বলেন, ‘যেখানে বাস দু মিনিট থামার কথা সেখানে ১০ মিনিটে দাঁড়িয়ে থাকে এটা আমাদের জন্য সমস্যা।’
তবে চালকরা বলছেন, নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডে যাত্রীরা বাসে ওঠা-নামা করতে না চাওয়ায় এমন পরিস্থিতি।
চালকদের একজন বলেন, ‘যাত্রী যদি নিয়ম মানে তাহলে আমরাও মানবো।’
চালকদের আরেকজন বলেন, ‘আমাদের তো বাস রাখার একটা স্ট্যান্ড দরকার, সেটা তো নেই।’
বাসের এমন অনিয়মের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় হঠাৎ জুড়ে বসেছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। বিশেষ করে২০ ২৪ সালের শুরু থেকেই বাড়তে থাকে যার দাপট। গেল বছরের মাঝামাঝি যার দখলে চলে যায় ঢাকার মূল সড়কও। যা দিন দিন যানজট বাড়িয়ে গতি কমাচ্ছে রাজধানীর।
যাত্রীদের একজন বলেন, ‘অটোরিকশা প্রধান সড়কে চলার কথা না, তবু চলছে দাপটের সঙ্গে। প্রতিদিন ৬-১০ জনের পা ভাঙছে।’
ট্রাফিক পুলিশের একজন বলেন, ‘ আমরা তাদের বলছি সরে যেতে। যত্রতত্র গাড়ি না রাখতে। যদি না শোনে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০০৫ সালে কৌশলগত পরিপত্র তৈরি হয়। তবে দীর্ঘসময় পেরিয়ে গেলেও কাঠামোর মধ্যে আনা যায়নি। সে সময় ১২৫টি রুটে গণপরিবহন চলাচলে রুট পারমিট থাকলেও বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৩শ’রও বেশি। এতে বাড়ছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
ড. শামসুল হক। ছবি: সংগৃহীত
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, ‘হাতিরঝিলে সাড়ে ৮ কিলোমিটারের একটা সার্কিট আছে সেখানে একটা কোম্পানি চলে এবং একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে যাত্রী উঠা নামা করে। চালক বেতনভুক্ত। একইভাবে গুলশানেও চলছে। এটি সারা ঢাকার শহরে জন্য মডেল হতে পারে।
পরিবহন নেতাদের স্বীকারোক্তি, মালিক-শ্রমিক বিরোধিতায় আলোর মুখ দেখছে না সরকারের উদ্যোগ। কয়েক দফায় কাউন্টার পদ্ধতিতে বাস চলাচল ও টিকিট ব্যবহারের কার্যক্রম হাতে নিলেও তা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়েছে।
ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি এম এ বাতেন, ‘মালিকরা -শ্রমিকরা ৫০ শতাংশ। সব মালিক শ্রমিক না। এরা গোপনে বিরোধিতা করে আমাদের। কারণ এই মালিক-শ্রমিকরা গত ১৪ বছর যাবত গাড়িগুলো চুক্তিভিত্তিক চালায়। পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনার জন্য যা যা করণীয় তা আমরা সহযোগিতা করবো। আমরা কথা দিয়েছি এই সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা দরকার।’
পরিবহন বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, বিগত সরকারগুলো রাজনৈতিক স্বার্থে পরিবহন খাতকে ব্যবহার করলেও পুরোনো সংস্কৃতি বদলানোর সময় এসেছে। গণপরিবহন সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে প্রকৌশল ও কারিগরি জ্ঞানকে গুরুত্ব দেয়াসহ সমস্যার মূলে হাত দেয়ার তাগিদ তাদের।
ঢাকার বাস কবে নির্ধারিত রুট ধরে চলাচল করবে আর কবেই বা ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণ আনা যাবে? এমন প্রশ্ন যখন নগরবাসীর মনে, তখন সরকারি সংস্থা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের কী উদ্যোগ?
ডিটিসিএয়ের ডেপুটি ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার ধ্রুব আলম বলেন, ‘মারামারি করে সে রাস্তায় জ্যামের সৃষ্টি করে। এর থেকে আপনি বেতন দিয়ে চালান সেটা মোটিভেশনের বিষয়। সময়ের ব্যাপার একটা। চালকদেরও বোঝার বিষয়। আমরা এইটা নিয়ে কাজ করছি। তাই বলে এখনই দৃশ্যমান কিছু দেখা যাবে তা কিন্তু না। দুুই সিটি করপোরেশন নীতিমালা খসড়া তৈরি করছে।