হওরাঞ্চলে কৃষিতে আশা জাগাচ্ছে যে প্রকল্প
কুয়াশা সিক্ত ভোরে দূর্বা ঘাসে মুক্তোদানার মতো ঝিকমিক করে শিশির কণা। সবুজ পাতায় দোল খায় ঝড়ে পড়া জলের বিন্দু। চোখজুড়ানো এই ভোরের সফেদ ক্যানভাসে জেগে ওঠা পলির দ্বীপে খাবারের সন্ধানে চরে নিঃসঙ্গ গাভী। খেই হারিয়ে জলের স্রোতে ভেসে যায় কচুরিপানার হল্লা। জলে জাল নামিয়ে চলে জেলেদের মাছের সন্ধান। মাছশূন্য জালের বহর। মলিন মনে তবুও কসরত। জীবনসংগ্রামে মুখর হাওরের বাসিন্দারা।
অপরূপ সুন্দর এ হওরাঞ্চল গড়ে উঠেছে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ এবং মৌলভীবাজার জেলা নিয়ে। এলাকাগুলো প্রধানত বোরো ধান নির্ভর। জলবায়ু ও পরিবেশগত নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে বারবার বিপর্যয়ের মুখে পড়ে এসব অঞ্চলের মানুষ। অর্থনৈতিকভাবে হয়ে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত। তবে সম্প্রতি একটি প্রকল্প হাওর জনপদের কৃষিতে আশা জাগাচ্ছে। এক ফসলের বিপরীতে সবজিসহ উৎপাদন হচ্ছে নানা ধরনের ফসল।
যুগ যুগ ধরে নদী খেকোদের দখল ও দূষণের সঙ্গে তৈরি হয়েছে নাব্য সংকটে। ভেসে উঠছে ক্ষতের চিহ্ন। বদলেছে গতিপথ। জরাগ্রস্ত নদীর বিরূপ প্রভাব এখন হাওর জনপদের জেলেদের জীবিকায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাওরে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে না পারলে বাড়বে বেকারত্ব-দারিদ্র্য।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি ও জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. তাসলিমা খানম বলেন, ‘যেহেতু হাওর অঞ্চলে মাছের উৎপাদন আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। এবং জেলেরা দেখা যায় যে প্রতিদিনই মাছ ধরতে যাচ্ছে। কিন্তু তারা খালি জাল নিয়ে ফিরে আসছে, মাছ পাচ্ছে না। এতে দেখা যায় তাদের যে জীবনযাত্রা এবং জীবিকা, তার উপর একটা বিরূপ প্রভাব পড়ছে।’
কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ এবং মৌলভীবাজার জেলার হাওরগুলো প্রধানত বোরো ধাননির্ভর। জলবায়ু ও পরিবেশগত নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এখানকার কৃষি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে। পড়ে বিরূপ প্রভাব হাওর জনপদের জীবন জীবিকায়।
একজন কৃষক বলেন, ‘আমরা ঠিকমতো খেতে পারি না। আমাদের সংসার চলে না। ডাল, চাল সবকিছুর দাম, আমরা কিছু আনতে পারি না, খেতে পারি না।’
নানা ঝুঁকি সত্ত্বেও হাওর অঞ্চলে কৃষি উন্নয়নের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। বলছেন, প্রচলিত বোরো ধান ভিত্তিক একক শস্য উৎপাদন থেকে বেরিয়ে যুক্ত করতে হবে ডাল, তেল ও সবজি চাষ।
কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) শাহীনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চাচ্ছি যে ফসলের বৈচিত্র্যতার পাশাপাশি একটি জমিতে যে অধিক আবাদ করা যায়। এবং কৃষকরা যে এই চাষাবাদেত উদ্বুদ্ধ হয়। আমরা তাদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। এবং ভবিষ্যতে লজিস্টিক সাপোর্টও আমরা তাদের দেয়ার চেষ্টা করবো।’
কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার চার সন্তানের জননী ফাহিমা আক্তার। দিনমজুর স্বামীর একা রোজগারে সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা। বর্তমানে নিজেই করছেন সবজির আবাদ। এতে পরিবারের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিক্রি করতে পারছেন বাড়তি ফসল। তার মতো গ্রামের অন্য কৃষকরা শাকসবজি, আলু থেকে শুরু করে সরিষার মতো লাভজনক ফসল উৎপাদন করে লাভের মুখ দেখছেন।
ফাহিমা আক্তার বলেন, ‘আমরা আমাদের হাওড় অঞ্চলের মধ্যে গাছগাছালি করে নিজে খাই আবার বিক্রিও করি। ছেলেমেয়ের লেখাপড়াও করাচ্ছি।’
প্রকল্পের আওতায় ১৪০টি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের হাওর জনপদের চার হাজার ২০০ কৃষক জলবায়ু সহনশীল এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতি গ্রহণের দক্ষতা অর্জন করেছেন। হাওর অঞ্চলে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষকদের ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।