‘ভারতীয় মিডিয়া আ. লীগের চেয়েও হাসিনাপ্রেমী’

সাক্ষাৎকারে শফিকুল আলম

ভারতীয় কিছু মিডিয়া আওয়ামী লীগের চেয়েও হাসিনাপ্রেমী বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনার অপকর্ম ও তার দুঃশাসনের সত্য ইতিহাস মানতে নারাজ ভারতীয় মিডিয়া।

জলজ্যান্ত সত্যকেও তারা স্বীকার করছে না। গোটা দেশকে দুর্নীতির সাগরে ডুবিয়ে একটা চোরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন শেখ হাসিনা। হাসিনার অপকর্ম যা দিবালোকের মতো সত্য, কোটি কোটি মানুষ সাক্ষী। কিন্তু সেগুলো স্বীকার করে না ভারতীয় মিডিয়া। আমার মনে হয় কি, কিছু ভারতীয় মিডিয়া আওয়ামী লীগের চেয়েও হাসিনাপ্রেমী।
এক সাক্ষাৎকারে শফিকুল আলম এ কথা বলেন। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অবস্থিত প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রেস সচিব এ সাক্ষাৎকার দেন।

পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর সদস্যরা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে- ভারতের একটি পত্রিকায় এমন দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুল আলম বলেন, এটা লক্ষ্য করছি যে, ভারতীয় গণমাধ্যম (বাংলাদেশ ইস্যুতে) অনেক ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে। আসলে বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতীয় সাংবাদিকদের তথ্য সমৃদ্ধ নয়। এ বিষয়ে ফোনালোপে প্রফেসর ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে অনুরোধ করেছিলেন, বাংলাদেশে এসে সরেজমিনে তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে ভারতীয় সাংবাদিকদের যেন তিনি উৎসাহিত করেন। কিন্তু তারা আসছেন না।

ভারতের দায়িত্বশীল গণমাধ্যমগুলোও মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, এই কাজটি তাদের ইচ্ছাকৃত না কি পতিত স্বৈরাচার সরকারের প্রতি তাদের যে প্রেম-ভালোবাসা ছিল সেটা হয়তো এখনও কমেনি।

ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংগঠনের ওয়েবসাইট (আইডিআরডব্লিউ.অর্গ) সম্প্রতি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, পাকিস্তান থেকে কিছু স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কিনছে বাংলাদেশ। বঙ্গপোসাগরে এই সামরিক অস্ত্র জমা করা হচ্ছে।

এই তথ্যের সত্যতা কী অথবা অসত্য হলে এই ধরনের মিথ্য সংবাদ প্রকাশের বিষয়ে কী বলবেন?

জবাবে শফিকুল আলম বলেন, এগুলো সবই সূত্রহীন, বায়বীয় সংবাদ। এসব সংবাদের কোনো সোর্স নাই, কে বলেছে তাও বলা নাই। সেটাই বলছি যে, ভারতীয় মিডিয়া মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। তাছাড়া আমরা কার কাছ থেকে কি কিনি এটা ভারতের দেখার বিষয় নয়। বাংলাদেশ ইস্যুতে খবর প্রকাশের আগে তাদের (ভারতীয় সাংবাদিকদের) উচিত ছিল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। কোনো তথ্য পেলে তারা চেক করতে পারে। বাংলাদেশের চিফ অ্যাডভাইজার প্রেস উইং ফ্যাক্টস থেকে নিশ্চিত হতে পারে। কথা বলতে পারে। কিন্তু তারা সেটা না করেই প্রতিবেদন লিখছেন। তাদের ইচ্ছাই হচ্ছে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো। সত্য শোনার ভয়ে তারা আমাকে ফোনও করছেন না।

তিনি বলেন, ভারতের গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশে তাদের ব্যুরো অফিস খুলুক। প্রতিনিধি নিয়োগ দিক। তাদের সরেজমিনে করা তথ্য নিয়ে প্রকাশ করুক। আমরা তো বাধা দিচ্ছি না, স্বাগত জানাচ্ছি। আমরা ভারতীয় সাংবাদিকদের এটাও বলেছি, বাংলাদেশে আসুন, আপনাদের ভিসা এক ঘণ্টায় করে দেব।

মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর কারিগর ভারতের সাংবাদিকতাকে কীভাবে দেখছেন প্রশ্নে প্রেস সচিব বলেন, ভারতের সাংবাদিকতা অনেক পুরোনো। জার্নালিজমে তাদের ভালো ভালো রেকর্ডও আছে। তাদের কিছু কিছু পত্রিকা, কিছু ওয়েবসাইট খুবই জনবান্ধব। আবার কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম খুবই উগ্রবাদী, পুরোপুরি গোদি মিডিয়া। তারা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ায়, যা উন্নত সমাজে দেখা যায় না।

ভারত কেন বাংলাদেশ নিয়ে এমন অপপ্রচারে ব্যস্ত? এটা সংখ্যালঘু ইস্যু নাকি পাকিস্তান ইস্যুর কারণে হচ্ছে প্রশ্নে শফিকুল আলম বলেন, আমি এটার স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারব না। তবে আমার মনে হয়, শেখ হাসিনার অপকর্ম ও তার দুঃশাসনের সত্যতা মানতে নারাজ ভারতীয় মিডিয়া। জুলাই-আগস্টে প্রায় ২ হাজার খুন হয়েছে, গত ১৫ বছরে ৩ হাজারের বেশি গুম হয়েছে। বিরোধীদলের ৫০-৬০ লাখ মানুষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের জীবনটা শেষ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের ছেলে-মেয়েরা চাকরিও পায়নি। গোটা দেশকে দুর্নীতির সাগরে ডুবিয়ে একটা চোরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন শেখ হাসিনা। আমাদের এখানে যা দিবালোকের মতো সত্য, হাসিনার অপকর্ম কোটি কোটি মানুষ সাক্ষী, অথচা এটা স্বীকার করে না ভারতীয় মিডিয়া।

গত তিন সপ্তাহ আগে ভারতের একটা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের গুপ্তচর সংস্থা ‘র’-এর সাবেক এজেন্ট লক্ষণ সিং বিস্ট (লাকি বিস্ট) ভারতের এক টেলিভিশন লাইভে বলছিলেন, (আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর) বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যু বাড়বে। তার ওই বক্তব্যের পর পরই দেখা গেল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সমন্বয়কদের গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিছু কিছু জায়গায় সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়েছে। র-এর সাবেক এজেন্টের বক্তব্যের সঙ্গে এসব ঘটনা সম্পর্কযুক্ত কি না?

জবাবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এগুলো বায়বীয়। এগুলো বলে অনেকে সুখ পায়। এগুলো নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক নয়। দেশে সম্প্রতি সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের যেসব ঘটনা ঘটেছে আমরা সব তথ্য দিয়েছি। কতজন গ্রেপ্তার হয়েছে সেই তথ্য দিয়েছি। এই ইস্যুতে আমরা খুবই সচেতন ও স্বচ্ছ।

গত ৯ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি ঢাকা সফরে এসে সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার উজ্জামানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে সংবাদ প্রচার করে দেশের একটি জাতীয় দৈনিক।

তাদের মধ্যে কী কথপোকথন হয়েছিল জানতে চাইলে প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, সেনাপ্রধানের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব কথা বলেছেন কি না- এমন তথ্য নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে এ তথ্য নিশ্চিত করার কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র উল্লেখ করা হয়নি। ‘সূত্র মতে জানা যায়’ লিখে প্রকাশিত সংবাদ নিয়ে মন্তব্য করা মুশকিল। তবে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব এসেছিলেন এবং সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছেন। ওনার আসায় আমরা মনে করি, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও উন্নয়ন হবে, আরও শক্তিশালী ও দৃঢ় হবে। আমরা আমাদের কথা বলেছি, তারা তাদের কথা বলেছেন। দুই দেশই চায় এই সম্পর্ক আরও জোরদার হোক।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ নয় দাবি করেন তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে কি ভারতের সম্পর্ক খুব খারাপ হচ্ছে! এটা তো গণমাধ্যমগুলোর ধারণামাত্র।

সম্প্রতি ভারতের সমুদ্র বন্দরকে বাদ দিয়ে মালদ্বীপের বন্দর ব্যবহার করে রপ্তানি করছে বাংলাদেশ- এ প্রসঙ্গ তুললে প্রেস সচিব বলেন, এগুলো অর্থনীতির বিষয় বা সমস্যা। এখানে রাজনৈতিক কোনো ইস্যু নেই।

সম্প্রতি সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের প্রসঙ্গ তুললে শফিকুল আলম বলেন, সবাই তদন্ত করে দেখেছে এটা নাশকতা নয়। লুজ কানেকশন থেকে স্পার্ক করে আগুনটা লেগেছে। ভিডিও হাতে আসার আগেই বিষয়টি বোঝা গিয়েছিল। পরে ভিডিওগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অনুমান মিলে গেছে। স্পার্ক থেকে অগ্নিকাণ্ড। ৯৯ শতাংশ নিশ্চিত যে, এখানে স্যাবোটাজ বা নাশকতা বলে কিছু নেই। দুই বা তিন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে আগুন লাগার কারণও জানিয়েছেন তদন্তকারীরা। তারা বলছেন, স্পার্কের কারণে পুরো করিডোরে আগুন জ্বলছিল। আর যেসব জায়গায় আগুন বেশি জ্বলতে দেখা গেছে সেখানে এসির বিস্ফোরণ ঘটেছিল। এতে আগুনের শিখা বেড়ে দাউ দাউ করে জ্বলছিল। ভেতরে কিন্তু আগুন জ্বলছিলই। সেটা বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল না।

কয়েকজন উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়ে অসন্তোষ দেখা গিয়েছিল, বিশেষ করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নিয়োগ নিয়ে সামাজিকমাধ্যমে সমালোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রেস সচিব বলেন, ফারুকী বাংলাদেশের স্বনামধন্য-গুণী নির্মাতা, তিনি বাংলাদেশের সংস্কৃতিটা বোঝেন। আমরা তো মনে করি, উপদেষ্টা পরিষদে তার যুক্ত হওয়াটা বাংলাদেশের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। সামাজিকমাধ্যমে কি বলছে সেটা জেনে তো আর সরকার চলবে না।

৫ আগস্টে পটপরিবর্তনের পর দেশের কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, কোথাও আন্দোলন করছেন শ্রমিকরা। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে আছে কি না জানতে চাইলে প্রেস সচিব বিষয়টি নাকচ করে দেন।

তিনি বলেন, আমাদের রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, গ্রোথ ডাবল ডিজিটে এখন। গত কয়েক বছরের মধ্যে কনটেইনার পরিবহনে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে চট্টগ্রাম বন্দর। কনটেইনার পরিবহন বেড়েছে ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এই প্রবৃদ্ধি অনেক। এটা নির্দেশনা দেয় যে, আমাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মতৎপরতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যও তাই বলছে। আমদানি বেড়েছে মানে আমাদের ব্যয়ক্ষমতা বেড়েছে। রপ্তানি বেড়েছে মানে আমাদের উৎপাদন বেড়েছে। কারখানাগুলো খুব ভালো করছে। অবশ্য স্বৈরাচারের দোসর যারা পালিয়ে গেছেন তাদের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে।

আগামীর বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে কি মনে করেন, জানতে চাইলে শফিকুল আলম বলেন, আমি মনে করছি, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে কাজ করবেন। নির্ভীক সাংবাদিকতা করবেন, পক্ষপাতদুষ্ট হবেন না। এক কথায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। অবশ্য সরকারে যারা থাকেন তাদের মধ্যে একটা অন্ধত্ব কাজ করে। একই বিষয় আমি যেভাবে দেখছি সাংবাদিকরা হয়তো আরও অনেক কিছু দেখছেন সেখানে। সাংবাদিকরা যদি তাদের সেসব বক্তব্য জানান, তখন আমার অর্থাৎ সরকারপক্ষের চোখটা খোলে। আমরা চাচ্ছি সাংবাদিকরা সেই দায়িত্বটা পালন করুক।

তিনি বলেন, আমরা দেখছি যে, সাংবাদিকতায় জুনিয়ররা ভালো বেতন পান না। এই বেতনের একটা সন্তোষজনক সীমা আমরা নির্ধারণ করে দিতে চাই। আবার চাই কেউ যেন কারো কনটেন্ট চুরি না করে। এভাবে জার্নালিজমকে এক্সপেনসিভ করতে হবে। জার্নালিজম সস্তা কিছু নয়।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.