পদ্মা সেতু ঘিরে পর্যটনের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে রিসোর্টটি এখন ফাঁকা। প্রকল্প শেষ হয়ে যাওয়ায় ব্যবহার হচ্ছে না কোনো বাড়ি। ফলে অলস পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে দামি সব অবকাঠামো আর আসবাব।
শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতু থেকে নেমে বাঁ দিকে তাকালেই চোখে পড়বে এই রিসোর্ট। নদীতীরে ৫৫ একর এলাকাজুড়ে বৃত্তাকারে গড়ে তোলা হয়েছে ৩০টি ডুপ্লেক্স বাড়ি। প্রতিটির আয়তন তিন হাজার বর্গফুট। ভেতরে সব দামি আসবাব আর তৈজসপত্রের সমাহার। বিলাসবহুল এ অতিথিশালা নির্মাণ হয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের আওতায়। দৃষ্টিনন্দন ভবন ছাড়াও সেখানে রয়েছে সুইমিংপুল, টেনিস কোর্ট, বাস্কেটবল কোর্ট, জিমনেশিয়ামসহ অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা।
সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু ঘিরে পর্যটনের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেই মূলত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে রিসোর্টটি নির্মাণ করা হয়েছে। যদিও প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত অতিথিশালার কয়েকটি বাড়ি শুরুতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কর্মকর্তারাই কেবল ব্যবহার করতেন। পরিদর্শনে গিয়ে মাঝেমধ্যে থাকতেন সরকারের মন্ত্রী-আমলারাও। প্রকল্প শেষ হয়ে যাওয়ায় এখন আর কোনো বাড়িই ব্যবহার হচ্ছে না। অলস পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে দামি সব অবকাঠামো আর আসবাব।
পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সার্ভিস এরিয়া-২ প্যাকেজের মাধ্যমে বিলাসবহুল অতিথিশালাটি নির্মাণ করা হয়েছে। এর কার্যাদেশ দেয়া হয় ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি। কাজ শেষ হয় ২০১৬ সালের জুলাইয়ে। এটি নির্মাণের জন্য ঠিকাদারের সঙ্গে প্রায় ২০৯ কোটি টাকার চুক্তি হয়, যদিও ব্যয় হয় ১৯৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
দেশের বৃহৎ এ সেতু ঘিরে নির্মিত পুরো অতিথিশালাটি পাঁচটি ক্লাস্টারে ভাগ করা। প্রতিটির রয়েছে নিজস্ব নাম—বকুল ভিআইপি রিসোর্ট, কামিনী রিসোর্ট, শাপলা রিসোর্ট, মাধবীলতা রিসোর্ট ও রজনীগন্ধা রিসোর্ট। বৃত্তাকারে সাজানো ক্লাস্টারগুলোয় রয়েছে ছয়টি করে ডুপ্লেক্স বাড়ি। এছাড়া অতিথিশালায় রয়েছে একটি দ্বিতল মোটেল মেস। প্রতি তলায় আছে ২০টি করে অ্যাপার্টমেন্ট, যেগুলোর প্রতিটির আয়তন ৩০০ বর্গফুট। এর বাইরে রয়েছে একটি অভ্যর্থনা ভবন। সেখানেও প্রশস্ত ডাইনিং হল ও জিমনেসিয়ামের ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যান্য সুবিধার মধ্যে আছে অফিস ভবন, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, টেনিস কোর্ট, বাস্কেটবল কোর্ট, সুইমিংপুল, মসজিদ, পাম্প হাউজ, বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন, গার্ড হাউজ ও পার্কিং এলাকা।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্মাণের পর অতিথিশালার কয়েকটি বাড়ি প্রকল্পের কর্মকর্তারা ব্যবহার করতেন। এর বাইরে ঢাকা থেকে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও আমলারা পরিদর্শনে গিয়ে বিভিন্ন সময় থেকেছেন। তবে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর অতিথিশালার কোনো বাড়িই আর ব্যবহার হচ্ছে না।
দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় অবকাঠামো ও দামি আসবাব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন পদ্মা সেতু সাইট অফিসের অতিরিক্ত পরিচালক শেখ ইসতিয়াক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এটা দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকার কারণে বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরুর আগে বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ দরকার। এখানে দামি জিনিস আছে, দামি ক্রোকারিজ আছে, বিছানা, বালিশ, চাদর, ফার্নিচার সবই দামি। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমরা একটা প্রস্তাব হেড অফিসে (সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয়) পাঠিয়েছি। রক্ষণাবেক্ষণের প্রস্তাবের পাশাপাশি আমরা সার্ভিস এরিয়া-২-এর অবকাঠামোগুলো দেখাশোনার জন্য অতিরিক্ত জনবলও চেয়েছি। তবে এখন পর্যন্ত হেড অফিস থেকে প্রস্তাবের বিষয়ে কোনো সাড়া পাইনি। নির্মাণের পর থেকে এখানকার অবকাঠামোগুলো কোনো রকমে আমরা রক্ষণাবেক্ষণ করছি। বেশি দিন এভাবে রাখলে প্রপার্টিগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।’
অতিথিশালাটি বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের সঙ্গে আলোচনা চলছে উল্লেখ করে শেখ ইসতিয়াক বলেন, ‘সার্ভিস এরিয়া-২ পরিচালনার দায়িত্ব বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনকে দেওয়ার জন্য একটা মৌখিক নির্দেশনা রয়েছে। তবে এ-সম্পর্কিত কোনো চুক্তি এখনো হয়নি। চুক্তির জন্য পর্যটন করপোরেশনের সঙ্গে একাধিক সভা হয়েছে। সংস্থাটির কর্মকর্তারা একাধিকবার পরিদর্শনও করেছেন। যদিও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা গত মাসেও পর্যটন করপোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। সে সময় তাদের একটি সমঝোতা স্মারকের খসড়া তৈরির ব্যাপারে অনুরোধ করা হয়।’
অন্যদিকে পর্যটন করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি না হলেও অতিথিশালাটি সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে ভাড়া দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রশাসন) আলতাফ হোসেন সেখ। তিনি বলেন, ‘এখানে নির্দিষ্ট ভাড়ার বিনিময়ে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ের যে কেউ যেন থাকতে পারেন, সেজন্য আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।’
এখন পর্যন্ত কতজন অতিথি সেখানে থেকেছেন এমন প্রশ্নে আলতাফ হোসেন বলেন, ‘সংখ্যাটি খুব কম। উল্লেখ করার মতো নয়। আর সেতু নির্মাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত সার্ভিস এরিয়া-২ প্রকল্পের কাজে ব্যবহার হয়েছে। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর এটা আমাদের হাতে এসেছে। পরিচালনার জন্য পর্যটন করপোরেশনের সঙ্গে আমরা অনেক দূর আলোচনা এগিয়ে নিয়েছি।’