কোরবানি শব্দটি ‘কুরবুন’ মূল ধাতু থেকে নির্গত। অর্থ হলো—নৈকট্য লাভ করা, প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা। শরিয়তের পরিভাষায়, নির্দিষ্ট জন্তুকে একমাত্র আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত নিয়মে মহান আল্লাহর নামে জবেহ করাই হলো কোরবানি। কোরবানি ইসলামের অন্যতম এক নিদর্শন, তার হুকুমের ব্যাপারে ইমামদের মতবিরোধ রয়েছে। জমহুর উলামাদের কাছে সুন্নতে মুয়াক্কাদা, হানাফি মাজহাবের মতে ওয়াজিব। এখন কথা হলো, কোরবানি কারা করবেন? যারা জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে নিজেদের নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ ছাড়া অতিরিক্ত সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা এর সমমূল্যের মালিক হন, তাদের ওপর কোরবানি করা আবশ্যক।
কুরবুন বা কোরবানি অর্থ আত্মত্যাগ, উত্সর্গ, বিসর্জন ইত্যাদি। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর নৈকট্যলাভের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহর নামে কোনো কিছু উত্সর্গ করার নামই কোরবানি। প্রচলিত অর্থে কোরবানি হলো পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে মহান রব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টিলাভের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তির নির্দিষ্ট পশু জবেহ করা। সুরা হাজে মহান রব্বুল আলামিন ঘোষণা করেন, ‘আমি প্রত্যেক জাতির ওপর কোরবানির নিয়ম করেছি, যাতে তারা চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করে এবং আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ সেই সঙ্গে সুরা কাওসারে বলা হয়, ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশে সালাত আদায় করো এবং কোরবানি করো।’
কোরবানির মুখ্য উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন করা। তাকওয়ার মাধ্যমেই আত্মা পরিশুদ্ধ হয়। সুরা আল-আনআমের ১৬২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বলো, আমার সালাত, আমার হজ ও কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ—সবই বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর উদ্দেশে।’ পশু কোরবানির সময় আমরা এমন দোয়াই করে থাকি। কোরবানি আমাদের শিক্ষা দেয়, আল্লাহর প্রেমে পূর্ণ তাকওয়া নিয়ে কোরবানি করতে হবে। জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র এই কোরবানির উত্সব বা ঈদুল আজহা শুধু প্রতীকী অনুষ্ঠান নয়; মনের গভীরে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও তাকওয়া নিয়ে প্রিয় বস্তু তার নামে উত্সর্গ করাই এর উদ্দেশ্য। আল্লাহর কাছে কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত কিছুই পৌঁছায় না। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহকে রাজি-খুশি করা, তার সন্তুষ্টি অর্জনই হলো মুখ্য উদ্দেশ্য। আল্লাহ বলেন, ‘আমার কাছে এগুলোর গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না, পৌঁছায় শুধু তোমাদের মনের তাকওয়া।’
কোরবানির দিন কোরবানি করা মহান রব্বুল আলামিনের কাছে সবচেয়ে বেশি পছন্দের। কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহ তাআলার দরবারে কবুল হয়ে যায়। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিস থেকে জানা যায়, নবি করিম (স.) বলেন, কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কোনো আমল আল্লাহর কাছে নেই। কোরবানিকারী কিয়ামতের দিন জবেহকৃত পশুর লোম, শিং, ক্ষুর, পশম ইত্যাদি নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। সেই সঙ্গে কোরবানির গুরুত্ব সম্পর্কে হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণিত এক হাদিস থেকে জানা যায়, নবি করিম (স.) বলেন, যে ব্যক্তির সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।
মানবজীবনে কোরবানির মূল শিক্ষা হলো সমাজের অভাবগ্রস্তদের সহমর্মিতার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পারস্পরিক সৌহার্দ প্রতিষ্ঠা করা। সেই সঙ্গে আল্লাহর রাস্তায় মানুষের আপন সম্পদ উৎসর্গ করা। যিনি যত পরিমাণ সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবেন, তিনি আল্লাহর তত নৈকট্য লাভ করবেন। কোরবানির ত্যাগ বা উত্সর্গ একটি বড় ইবাদত। কোরবানির তাত্পর্য হলো আমাদের ভেতরের পশুত্ব, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ও বীভত্সতা দূর করা। অন্তরের মধ্যে বসবাসকারী পশুকে জবাই করা। এবং সেই সঙ্গে হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা বিসর্জন দিয়ে মানবতা ও ভ্রাতৃত্বধে উজ্জীবিত হওয়া। এটাই বান্দার কাছে পবিত্র কোরবানির মহান শিক্ষা। এতে করে আমাদের মনে আত্মশুদ্ধি আসবে। সেই সঙ্গে অর্জিত হবে মনের তাকওয়া। আল্লাহর প্রেম শুধু কোরবানির দিনে সীমাবদ্ধ না রেখে আজীবন অব্যাহত রাখতে হবে। সর্বক্ষণ মনে জাগ্রত রাখতে হবে কোরবানির মহান শিক্ষাকে। সেই সঙ্গে কোরবানি শিরক থেকে মুক্ত থাকার একটি কার্যকর মাধ্যম। ইসলাম মুসলিমদের কোরবানির বিধান দিয়ে তাওহিদ তথা একত্ববাদের বিশ্বাসকে উজ্জ্বল ও দৃঢ়করণের পাশাপাশি এই শিক্ষাও দেওয়া হয়েছে যে, এসব সৃষ্টি করা হয়েছে কোরবানি করে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য। এর দ্বারা একদিকে যেমন তাওহিদের বিশ্বাস শানিত হয়, তেমনি মানুষকে ইসলামের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব। কোরবানির মাধ্যমে নিজেদের বিবেককে জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন। আর তবেই আমাদের পৃথিবী হয়ে উঠবে সুন্দর ও শান্তিময়।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.