মোদি ম্যাজিকে ধস, চমক দেখালো কংগ্রেস
ভারতে চারশর বেশি আসন পাওয়ার স্লোগান দেওয়া বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির এনডিএ জোট এবার লোকসভা নির্বাচনে তিনশর লক্ষ্যই ছুঁতে পারেনি। বিভিন্ন গণমাধ্যমের বুথফেরত জরিপের পূর্বাভাসকে মিথ্যা প্রমাণ করে ২৯৬ আসনে আটকে গেছে দেশটির কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা এনডিএ জোট। বেসরকারিভাবে পাওয়া প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট জয় না পেলেও বিজেপি এবার পায়নি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এ ক্ষেত্রে সরকার গঠন করতে হবে শরিক দলগুলো নিয়ে।
এ ফলাফলকে মোদির জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
নির্বাচনে এনডিএর এমন বিপর্যয়ের নানা কারণ থাকলেও বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর যুক্তিনির্ভর প্রচারণার কারণে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বিজেপির। তবে বেসরকারি ফলাফল ঘোষণার পর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় মোদি নিজেকে বিজয়ী দাবি করে বলেন, এটা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের বিজয়। মানুষ টানা তৃতীয়বারের মতো এনডিএর ওপর আস্থা প্রকাশ করেছে। এটা ঐতিহাসিক ঘটনা। অন্যদিকে বিরোধীরা বলছেন, নরেন্দ্র মোদিকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না জনগণ। তাঁর পদত্যাগ করা উচিত।
ভারতের কেন্দ্রে সরকার গড়তে প্রয়োজন ২৭২ আসন। এনডিএ সেই লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিরোধী কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট পেয়েছে ২৩১ আসন। অন্যরা জয় পেয়েছে ১৬টিতে। বিজেপি এককভাবে জিতেছে ২৪৩ আসনে। কংগ্রেস পেয়েছে ৯৭টি। এ দুই দলের বাইরে অন্য দলগুলো জিতেছে ২০৩ আসনে। নির্বাচনে ৪৪ দশমিক ১৯ শতাংশ ভোট পেয়েছে এনডিএ জোট। ইন্ডিয়া জোট পেয়েছে ৪১ দশমিক ৪১ শতাংশ। ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ ভোট গেছে বাকি দলগুলোর ঝুলিতে। উত্থানের মধ্য দিয়ে কংগ্রেসকে লোকসভায় আনুষ্ঠানিক বিরোধী দলের ভূমিকায় দেখা যাবে; অর্থাৎ লোকসভায় আবার বিরোধী দলীয় নেতার পদ ফিরছে।
নির্বাচনে বিজেপির অনেক হেভিওয়েট প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে। এমনকি অযোধ্যার মতো লোকসভা আসনে বিজেপি হারের মুখ দেখেছে। সেখানে সমাজবাদী পার্টির নেতা স্বদেশ প্রদেশ জয়ী হয়েছেন। গত ২২ জানুয়ারি ভোটের আগে তড়িঘড়ি করে অযোধ্যায় রামমন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন নরেন্দ্র মোদি। নির্বাচনের প্রচারণায় বিজেপি রামমন্দির সামনে আনতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত বিরোধীদের ‘বেকারত্ব’, ‘মূল্যস্ফীতি’র মতো ইস্যুর কাছে তা পেরে ওঠেনি। কার্যত বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট যে সহজ জয় প্রত্যাশা করেছিল, তা তারা পায়নি।
প্রকাশিত ফল অনুযায়ী, উত্তরপ্রদেশের বারাণসী থেকে মোদি ও গুজরাটের গান্ধীনগর থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নির্বাচিত হয়েছেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী কেরালার ওয়েনাড় ও উত্তরপ্রদেশের রায়বেরেলি– উভয় আসন থেকেই নির্বাচিত হন। উত্তরপ্রদেশের কানৌজ থেকে সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব ও মইনপুর থেকে তাঁর স্ত্রী ডিম্পল যাদব নির্বাচিত হয়েছেন। জয় পেয়েছেন কংগ্রেসের শশী থারুরও। জয়ী হয়েছেন এআইএমআইএমের নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি, বিজেপির অনুরাগ ঠাকুর। নির্বাচনে বিভিন্ন দল থেকে ৭৮ জন মুসলিম প্রার্থী অংশ নিয়ে জয়ী হয়েছেন ১৫ জন।
উত্তরপ্রদেশের বহুল আলোচিত আসন আমেথি থেকে বিস্ময়কর জয় পেয়েছেন কংগ্রেসের কিশোরীলাল শর্মা। নির্বাচনে এ আসনের দিকে সবার বিশেষ নজর ছিল। এটি গান্ধী পরিবারের আসন হিসেবে পরিচিত থাকলেও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এখানে জয় পান বিজেপি নেতা অভিনেত্রী স্মৃতি ইরানি। তিনি রাহুল গান্ধীকে হারিয়ে দেন। এবার আমেথি থেকে রাহুল গান্ধী প্রার্থী না হলেও কিশোরী লাল শর্মাকে প্রার্থী করা হয়। এই কিশোরী লাল গান্ধী পরিবারের আস্থাভাজন হলেও রাজনীতিতে তিনি সব সময় থেকেছেন অন্তরালের নায়ক। এবার বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাবেক মন্ত্রী স্মৃতি ইরানিকে হারিয়ে তিনি চমক দেখিয়েছেন। তিনি ১ লাখ ৬০ হাজার ভোটের ব্যবধানে তাঁকে পরাজিত করেন।
নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, কর্ণাটক ও আসামে বিস্ময়কর ফল করেছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স বা ইন্ডিয়া জোট। দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মণিপুরে দুটি লোকসভা আসনেই জিতেছে কংগ্রেস।
পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে ২৯টিতেই জিতেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। বিজেপি পেয়েছে ১২টি আসন। একটি আসন পেয়েছে কংগ্রেস। সাত দফার ভোট চলাকালে রাজ্যটিতে এসে দফায় দফায় সভা-সমাবেশ করে গেছেন মোদি। সে ক্ষেত্রে বিজেপির প্রত্যাশা ছিল আরও অনেক বেশি। বুথফেরত জরিপেও বিজেপি তৃণমূলের চেয়ে বেশি আসন পাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি ১৮টি ও তৃণমূল কংগ্রস ২২টি আসনে জয় পেয়েছিল।
উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের ক্ষমতায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার থাকলেও সেখানে বড় ধরনের পরাজয় দেখেছে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ)। রাহুল-অখিলেশ জুটির প্রভাবে উত্তরপ্রদেশে বিস্ময়কর ফল করেছে ইন্ডিয়া জোট। টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, সেখানে ৮০টি লোকসভা আসনের ৪২টিতে জয়ী হয়েছে ইন্ডিয়া জোট; এনডিএ পেয়েছে ৩৭টি আসন। একটি আসনে অন্য দলের প্রার্থী জয় পেয়েছেন। ২০১৯ সালের নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে বিজেপি একাই ৬২ আসন পেয়েছিল। কংগ্রেস একটি আসনে জয় পায়। এবার কংগ্রেস ৬টি আসনে জিতেছে।
মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা ও শারদ পাওয়ারের এনসিপির কৌশলের কাছে বিজেপির উচ্চাভিলাষ হোঁচট খেয়েছে। সেখানে ইন্ডিয়া জোট পেয়েছে ২৯টি আসন। ১৮টি আসনে জয় পেয়েছে এনডিএ। অন্য দল থেকে একজন জিতেছেন। ২০১৯ সালে বিজেপি ২৩ আসনে জেতে।
কর্ণাটকের ২৮ আসনের মধ্যে বিজেপি-জেডিএস জোট ১৮ আসনে জয়ী হয়েছে। কংগ্রেস পেয়েছে ১০টি আসন। ২০১৯ সালে সেখানে বিজেপি জোট ২৫ আসনে জয়ী হয়। রাজস্থানে ২৪টি লোকসভা আসনের আটটি ছিনিয়ে নিয়েছে কংগ্রেস। ২০১৯ সালে সব আসনে জয় পেয়েছিল তারা।
২০১৯ সালে বিজেপি একাই ৩০৩ আসনে জয় পেয়েছিল। মাত্র ৫২টি আসনে জিতেছিল কংগ্রেস। তৃণমূল পেয়েছিল ২২টি আসন। এবার কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের আসন বেড়েছে।
নির্বাচনে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা। দুইবার ভারত জোড়ো যাত্রায় রাহুল দেশটির বিভিন্ন রাজ্য ঘুরে ঘুরে সমাবেশ করেন। এ সময় তিনি মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব নিয়ে মোদি সরকারের সমালোচনা করেন।
তবে সবচেয়ে বড় চমক দেখিয়েছেন কংগ্রেসের প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। তিনি কোনো আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেননি। দলটির মূল প্রচারকের ভূমিকায় ভারতজুড়ে সভা-সমাবেশ করে বেড়িয়েছেন। উত্তরপ্রদেশের আমেথি ও রায়বেরেলিতে ছিলেন সক্রিয় ভূমিকায়। মনে করা হয়, আমেথিতে তাঁর প্রচারণা ও কৌশলেই স্মৃতি ইরানিকে হারানো সম্ভব হয়েছে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে কার্যত কংগ্রেসের নতুন চমক হয়ে সামনে এসেছেন প্রিয়াঙ্কা। প্রচারে নেমে নানা ইস্যুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে যুক্তি দিয়ে সমালোচন করায় নতুন করে আলোচনায় এসেছেন তিনি।
তীব্র তাপদাহের মধ্যে গত ১৯ এপ্রিল শুরু হওয়া ভারতের সাত দফা নির্বাচন শেষ হয় গত ১ জুন। ওই দিন সন্ধ্যায় ভারতের গণমাধ্যমগুলো একযোগে বুথফেরত জরিপ প্রকাশ করে। এসব জরিপের কোনো কোনোটিতে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটকে চার শতাধিক আসনও দেওয়া হয়। প্রায় প্রতিটির পূর্বাভাসে বলা হয়, বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট সাড়ে তিনশর বেশি আসন পেতে যাচ্ছে। প্রশান্ত কিশোরের মতো ভোটকৌশলী ভবিষ্যদ্বাণী করেন, বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ জোট সাড়ে তিনশর বেশি আসন পাবে। নির্বাচনের ফলাফল এসব পূর্বাভাস ও ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করেছে। পাশাপাশি বিজেপি ক্রমে অজনপ্রিয় হওয়ারও আভাস দিয়েছে।
ভোটের সাফল্য প্রসঙ্গে রাহুল গান্ধী বলেন, ‘জনগণ মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপিকে শাস্তি দিয়েছে। এ দেশের মানুষের প্রতি আমার আস্থা সব সময় ছিল। ভারতের জনগণ চায় না– নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ দেশ শাসন করুন। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেছেন, নির্বাচনে ফলাফল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য ‘নৈতিক ও রাজনৈতিক পরাজয়।’ একই সুরে কথা বলেছেন বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ। তিনি বলেন, নির্বাচনে ইন্ডিয়া জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি– এটা সত্য। তবে এ ফল বিজেপির জন্য নৈতিক পরাজয়। মোদির উচিত পদত্যাগ করা। আর এটাই এ নির্বাচনের মূল বার্তা।
ফল ঘোষণার পর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, মোদি ও তাঁর দল ‘ঔদ্ধত্য’র কারণে হেরেছে। আলজাজিরাকে তিনি বলেন, ‘আমি খুশি যে প্রধানমন্ত্রী মোদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। তিনি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন। তাঁর উচিত অবিলম্বে পদত্যাগ করা।’ মমতা বলেন, অনেক নির্মমতা, বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়, ঔদ্ধত্য– সবকিছুর পর ইন্ডিয়া জোট জিতেছে, মোদি হেরেছেন। তারা অযোধ্যার মতো আসনেও হেরেছেন।