করোনার সময় চাকরি হারানো পঞ্চগড়ের গৃহবধূ খাদিজা আক্তার। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভালো চাকরি হারিয়ে তিনি যেন জীবনযুদ্ধে অথই সাগরে পড়লেন। কিন্তু দমে গেলেন না। এক পর্যায়ে নিজের শেখা সুই-সুতার কাজেই অবলম্বন খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করলেন।
যুব উন্নয়নে নারীদের নকশিকাঁথা প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করেন। এসব প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়েই শুরু করেন নকশিকাঁথা তৈরি। শুরুতে তেমন সাড়া না পেলেও ধীরে ধীরে তাঁর নকশিকাঁথার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে। এমনকি তাঁর দলের তৈরি নকশিকাঁথা যাচ্ছে এখন ইন্দোনেশিয়াতেও।
এ ছাড়া দেশের বাজারেও বেশ চাহিদা রয়েছে তাঁদের নকশিকাঁথার। চাহিদা এতটাই বেশি যে এখন জোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে।
জেলা শহরের রামেরডাঙ্গা এলাকায় গিয়ে দেখা যায় একটি বাড়ির উঠানে বসে চলছে সুই-সুতার কারবার। নিখুঁতভাবে কাঁথায় নকশা তৈরির কাজে ব্যস্ত নারীরা।
কাজে যত্নের কমতি নেই। বাড়ির কাজের পাশাপাশি চলছে কাঁথা নির্মাণের কাজ। নারী কর্মীরা জানান, প্রথমে বিভিন্ন রঙের কাপড় ক্রয় করে তাতে নকশা করা হয়। সেই নকশা অনুযায়ী সুতা বাছাই করে শুরু করা হয় সেলাইয়ের কাজ। পুরো সেলাই প্রক্রিয়া চলে হাতের মাধ্যমে।
প্রতি কাঁথা সেলাই করে একজন নারী মজুরি পান এক হাজার টাকা পর্যন্ত। এভাবে তাঁরা সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করছেন।
নান্দনিক নানা নকশার কারণে এই নারী দলের কাঁথার চাহিদা রয়েছে দেশ-বিদেশে। বর্তমানের দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সুদূর ইন্দোনেশিয়াতে যাচ্ছে তাঁদের কাঁথা। মোট ৩২ লাখ টাকার অর্ডার পেয়েছেন খাদিজা। এরই মধ্যে দুই দফায় ৪০০ কাঁথা ইন্দোনেশিয়াতে পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় বাজারেও লক্ষাধিক টাকার নকশিকাঁথা বিক্রি করছেন। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে বসবাস হলেও স্বামী-সন্তান নিয়ে বর্তমানে পঞ্চগড় জেলা শহরের রওশনাবাগ এলাকায় বসবাস করছেন খাদিজা।
খাদিজা আক্তার বলেন, ‘করোনার দামি চাকরি হারানোর পর আমি হতাশ হয়ে পড়ি। পরে আমার শেখা নকশিকাঁথা তৈরির বিদ্যাই কাজে লাগাই। যুব উন্নয়নে প্রশিক্ষক হিসেবে নকশিকাঁথার প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করি। পরে প্রশিক্ষণার্থী ৮০ জন নারীকে নিয়ে আমি নকশিকাঁথা তৈরি ও বিক্রয়ের উদ্যোগ নিই। এখন আমাদের তৈরি কাঁথা ইন্দোনেশিয়াতে যাচ্ছে। অন্যান্য দেশ থেকেও চাহিদা পাচ্ছি কিন্তু পুঁজির অভাবে জোগান দিতে পারছি না। ব্যাংকগুলোতে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধাও পাওয়া যায় না। সরকার আমাদের পাশে দাঁড়ালে আমি প্রান্তিক নারীদের নিয়ে আরো ভালো কিছু করতে পারব। দেশের জন্য রেমিট্যান্স আনতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘আমার এই দলে অসহায়, স্বামী পরিত্যক্তা, দরিদ্র নারী ও স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও রয়েছে। তাদের নিয়ে যুব উন্নয়ন সংঘ গড়ে তুলেছি।’
পঞ্চগড় রামেরডাঙ্গা এলাকার আঁখি আক্তার বলেন, ‘আমরা সংসারের কাজের পাশাপাশি নকশিকাঁথা সেলাই করি। এখান থেকে আমরা যে মজুরি পাই তা দিয়ে সংসারের কাজে লাগাই।’
সুমি আক্তার নামে আরেক নারী কর্মী বলেন, ‘আমরা খুব যত্ন করে কাঁথাগুলোতে নকশা করি। লতা, পাতা ও ফুল—এসবের নকশাই বেশি হয়। আমাদের তৈরি কাঁথা এখন ইন্দোনেশিয়াতে যাচ্ছে এটা আমাদের জন্য গর্বের।’
পঞ্চগড় সদর উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আওলাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা নারীদের আত্মনির্ভরশীল ও সাবলম্বী করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। খাদিজা পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য অনন্য উদাহরণ। আমরা চাই খাদিজার মতো নারীরা এগিয়ে আসুক। নারীরা সাবলম্বী হলেই সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলোকেও আমরা অনুরোধ করব এমন নারী উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াতে।’