দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পদক্ষেপ ও পদ্ধতি ছিল অনন্য। অন্যায়, অবিচার, কলহ-বিবাদ, দুর্নীতি, অরাজকতা দূরীভূত করে তিনি একটি শান্তিপূর্ণ কল্যাণমূলক আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। তিনি দল-মত-গোত্র-নির্বিশেষে সবার মধ্যে শান্তিচুক্তি এবং সন্ধি স্থাপনের মধ্য দিয়ে সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করেন। তাঁর অনুপম চরিত্র-মাধুর্য ও সত্যনিষ্ঠার কথা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল।
কিশোর বয়সে তিনি ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক শান্তিসংঘ গঠন করে সামাজিক অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আর্তমানবতার সেবা, অত্যাচারীকে প্রতিরোধ, মজলুমের সহযোগিতা ও শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ছিল এ শান্তিসংঘের অঙ্গীকার বাণী। মানুষের কল্যাণে তাঁর গড়া স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটি পৃথিবীর প্রথম সাংগঠনিক রীতিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজ সংস্কারমূলক প্রতিষ্ঠান। যার মাধ্যমে তিনি সমাজজীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী সব কার্যক্রম প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিয়ে মক্কা থেকে যাবতীয় অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ ও দুর্নীতি উচ্ছেদ করে সুশীলসমাজ গঠনে সচেষ্ট হন।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয়ের পর মক্কার বাজারে তদারকি করার জন্য সাঈদ ইবনে সাঈদ ইবনুল আস (রা.)-কে নিযুক্ত করেছেন। শুধু তা-ই নয়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং বাজারে গিয়ে খাদ্যে ধোঁকাবাজি কিংবা ভেজাল হচ্ছে কি না সে খবরদারি করতেন। একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাদ্যশস্যের একটি স্তূপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তিনি স্তূপের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলেন, ফলে হাতের আঙুলগুলো ভিজে গেল।
তখন স্তূপের মালিককে ডেকে বললেন, এ কি ব্যাপার? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুল, এতে বৃষ্টির পানি লেগেছে। তিনি বলেন, ‘সেগুলো তুমি স্তূপের ওপরে রাখলে না কেন? তাহলে লোকেরা দেখে নিতে পারত। জেনে রাখো, যে ব্যক্তি ধোঁকাবাজি করে, সে আমার উম্মত নয় (আমার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই)।’ (বুখারি, হাদিস : ২৫৫৪)
নিরপেক্ষভাবে অধীনস্থের অধিকার আদায়ে কাজ করা এবং জনগণের জান-মালের হেফাজত করা শাসকের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল।
আর (কিয়ামত দিবসে) তোমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। সুতরাং জনগণের শাসকও একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর পুরুষ তার পরিবারের একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাবাদ করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর ঘরসংসার ও সন্তানের দায়িত্বশীল, তাকে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। গোলাম তার মনিবের মালসম্পদের ওপর একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই একেকজন দায়িত্বশীল। আর তোমাদের প্রত্যেককেই (কিয়ামত দিবসে) তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ২৫৫৪)।
দুর্নীতিবাজ শাসকের ব্যাপারে হুঁশিয়ার বাণী উচ্চারণ করে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কোনো বান্দাকে যদি আল্লাহ জনগণের নেতৃত্ব প্রদান করেন, আর সে যদি কল্যাণ কামনার সঙ্গে তাদের তত্ত্বাবধান না করে, তাহলে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।’ (বুখারি, হাদিস : ৭১৫০)
সমাজ থেকে অন্যায়, অবিচার ও দুর্নীতি দমন করে একটি আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আজীবন প্রয়াস বিশ্বমানবতার জন্য মহান অনুকরণীয় আদর্শ।
লেখক : মুহাদ্দিস, মদিনাতুল উলুম মাহমুদিয়া, না.গঞ্জ