অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য যেমন সুদমুক্ত ইসলামী অর্থনীতির প্রয়োজন। তেমনি পরকালে মুক্তির জন্যও সুদমুক্ত ইসলামী অর্থনীতি প্রয়োজন। কারণ খাবার যদি হারামমুক্ত না হয়, তাহলে ইবাদত কবুল হয় না। সুদ ও হারাম রিজিকের কারণে কবরে আজাব হয়।
অন্যদিকে হালাল রিজিক গ্রহণ করলে ইবাদতে উৎসাহ সৃষ্টি হয়। আর হারাম গ্রহণ করলে ইবাদতের স্বাদ বিলুপ্ত হয় ও ইবাদতের আগ্রহ কমে যায়।
সুদ সব সময় নিষিদ্ধ ছিল : সুদের বিপরীতে মহান আল্লাহ বেচাকেনাকে হালাল করেছেন। সুদ আগে থেকে নিষিদ্ধ ছিল।
পৃথিবীর কোনো জাতির জন্য ঐশীভাবে সুদ হালাল ছিল না। জাহেলি যুগে সুদকে সামাজিক বিষয় বানিয়ে ফেলেছিল। তারা সুদ ছাড়া জীবনকে অচল মনে করত; যেমন বর্তমানে মনে করা হয়। তাই হঠাৎ করে আল্লাহ সুদকে হারাম করেননি; বরং ধীরে ধীরে তা হারাম করেছেন।
চার স্তরে সুদ হারাম : চার স্তরে মদের মতো সুদ হারাম করা হয়েছে— প্রথম স্তর : সর্ব প্রথম সুদের নিন্দা জানিয়ে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যেসব সুদ প্রদান করো মানুষের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য তা আল্লাহর কাছে বাড়বে না। আর তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে জাকাত আদায় করো তাদের দ্বিগুণ দেওয়া হবে।’ (সুরা রুম, আয়াত : ৩৯)
এ আয়াতে সুদ হারাম করা হয়নি; তবে সুদের নিন্দা করা হয়েছে।
দ্বিতীয় স্তর : সুদের কারণে আগের উম্মতের ওপর আজাবের কথা বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আমি ইহুদিদের জুলুমের কারণে তাদের জন্য যেসব পবিত্র বস্তু বৈধ ছিল, তা তাদের প্রতি অবৈধ করেছি এবং যেহেতু তারা অনেককে আল্লাহর পথ থেকে প্রতিরোধ করত এবং তারা সুদ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও গ্রহণ করত…।
’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৬০)
এ আয়াতে ইঙ্গিতাকারে সুদ হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এই আয়াত মদিনায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ আয়াত নাজিল হওয়ার পর অনেকে সুদ বর্জন করেছে।
তৃতীয় স্তর : চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে বিশ্বাস স্থাপনকারীরা, তোমরা দ্বিগুণের ওপর দ্বিগুণ সুদ ভক্ষণ কোরো না এবং আল্লাহকে ভয় করো, যেন তোমরা সুফলপ্রাপ্ত হও। আর তোমরা সেই জাহান্নামকে ভয় করো, যা অবিশ্বাসীদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩০)
চতুর্থ স্তর : চূড়ান্তভাবে দশম হিজরিতে সুদ হারাম করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে কঠোরভাবে সুদ বর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে বিশ্বাস স্থাপনকারীরা, আল্লাহকে ভয় করো এবং যদি তোমরা মুমিন হও, তাহলে সুদের মধ্যে যা বাকি আছে তা বর্জন করো। কিন্তু যদি তা না করো তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। যদি তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করো, তাহলে তোমাদের জন্য তোমাদের মূলধন আছে। তোমরা অত্যাচার করবে না আর তোমরা অত্যাচারিত হবে না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৮)
এ আয়াত দশম হিজরিতে চূড়ান্তভাবে হারাম করা হয়েছে। তাই নবী (সা.) বিদায় হজের সময় তিনি তা চূড়ান্তভাবে হারামের ঘোষণা করেছিলেন। আর আব্বাস (রা.)-এর লেনদেনকে সমাপ্ত করেছিলেন। তিনি তার সুদ মওকুফ করে মূল পুঁজি ফেরত প্রদান করার জন্য বলেছিলেন। তিনি বিদায় হজের ভাষণে যাবতীয় অবৈধভাবে অন্যের সম্পদ গ্রাস করা থেকে নিষেধ করেন।
সুদ ও মুনাফার মৌলিখ পার্থক্য : সুদ ও মুনাফা দুই পদ্ধতিতে সম্পদ অর্জিত হয়। তাই মুশরিকরা দুটির মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনি। তারা বলেছিল, বেচাকেনাও সুদি লেনদেনের মতো। অথচ উভয়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে।
উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হলো—
► সুদ সার্বসাকল্যে ক্ষতি। তাতে কোনো কল্যাণ নেই। এমনকি সুদখোরের জন্যও নেই। তাই তা অনেক চারিত্রিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ। আর সুদখোর যে সাময়িক ফায়দা মনে করে তা সাময়িক। তা দ্রুত ফুরিয়ে যাবে ও পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার কোনো ফলাফল পাওয়া যাবে না; বরং এর কারণে কবরে আজাব হবে। এর বিপরীতে মুনাফা; তাতে বরকত ও হালাল রিজিক আছে। তা দ্বারা ইবাদতের আগ্রহ সৃষ্টি হয়, মনে প্রশান্তি আসে।
► সুদ গরিবের প্রতি জুলুম। আল্লাহ জুলুম হারাম করেছেন। আর মুনাফা মহান আল্লাহর দয়া ও অনুদান।
► সুদ রোগাক্রান্ত ও অভাবী ব্যক্তিকে বিপদে ফেলার কৌশল। আর মুনাফা হলো মানুষের চাহিদা পূরণের ফলাফল।
► সুদে মানসিক ক্ষতি আছে, যা মুনাফায় নেই।
► মুনাফার সন্ধান করা ইবাদত। তাতে আল্লাহর ভয় থাকে। এর বিপরীতে সুদ আল্লাহর নাফরমানি ও প্রবৃত্তির অনুসরণ।
► মুনাফায় ঈমান বাড়ে। অন্তরে রহমত আসে। আর সুদের কারণে অন্তর পাষাণ হয়, অহংকার ও কৃপণতা আসে।
► মুনাফার কারণে মানুষের মধ্যে মিল-মহব্বত জন্মে এবং হিংসা দূর হয়। আর সুদ সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে এবং হিংসার উদ্রেক ঘটায়।
► সুদ মানুষের সম্পদ বিনিময়বিহীন গ্রহণ করার পথ। আর মুনাফা এর বিপরীত।
► সুদ চূড়ান্তভাবে হারাম। আর মুনাফা চূড়ান্তভাবে হালাল।
► সুদ খাওয়া আল্লাহর নিয়ামতের অকৃতজ্ঞতা। আর মুনাফা আল্লাহর দয়া তালাশ করা।
► সুদে লভ্যাংশ নির্দিষ্ট। মুনাফায় অনির্দিষ্ট। তাই মুনাফা ঝুঁকি বহনের পুরস্কার।
► সুদে ক্ষতির আশঙ্কা নেই। আর মুনাফায় ঝুঁকি থাকে।
► সুদ সময়ের বিপরীতে অতিরিক্ত। আর মুনাফা কাজের বিপরীতে অর্জিত।
► সুদের সম্পর্ক ঋণ ও সময়ের সঙ্গে। আর মুনাফার সম্পর্ক বেচাকেনার সঙ্গে।
► সুদ অনেক সময় চক্রবৃদ্ধি আকারে হয়। মুনাফা এর বিপরীত।
► সুদ ঋণের চুক্তি। আর মুনাফা আর্থিক সম্পদের বিনিময়।
► মুনাফা হলো ব্যবসানির্ভর। আর সুদ আর্থিক লেনদেনভিত্তিক।
► সুদপ্রথা সামাজিক বন্ধন ছিন্ন করে। আর মুনাফা তা বৃদ্ধি করে।
► সুদ মানুষকে দুর্ভাগা বানায়। আর মুনাফা সৌভাগ্যবান বানায়।
► ইসলামে সুদ কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস দ্বারা নিষিদ্ধ। সুদ খাওয়া কবিরা গুনাহ।
► কারো কাছে যদি অজান্তে বা অপারগতায় কোনো সুদের টাকা এসে যায়, তাহলে তা কোনো গরিব বা সমাজকল্যাণমূলক কাজে হারাম থেকে মুক্তির নিয়তে সদকা করা ওয়াজিব। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়