পেলের জীবনী

দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবলারদের যেভাবে যাত্রা শুরু, সেভাবেই পেলেও শুরু করেছিলেন। ব্রাজিলের প্রাদেশিক শহর ট্রেস করকোসে দারিদ্র্যের মধ্যে তাঁর জন্ম। কঙ্করময় মাঠে জুতা ছাড়া ছিন্নবস্ত্রকে বল বানিয়ে খেলেছিলেন তরুণ পেলে। তাঁর বাবাও ছিলেন খেলোয়াড়। তিনি ছোট থাকতেই ছেলের খেলার গুণ ধরতে সক্ষম হন এবং পেলের বয়স যখন ১৫, তখনই তঁাঁকে প্রমোশন দিয়ে বড়দের সঙ্গে খেলতে দেওয়া হয়। ১৬ বছর বয়সে সাও পাওলোতে নিয়ে তাঁর খেলা পরীক্ষা করা হয়। সেখান থেকে শুরু করে, ১৭ বছরের অধিক সময়ে তিনি ১২শর অধিক খেলা খেলেছেন। সাও পাওলোর সান্তোসে এসে তিনি ক্লাব ফুটবলে যোগ দেন এবং তখন ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ৫৮ গোল করেন এবং লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ব্রাজিলে সত্যিকার অর্থে জাতীয় লিগ প্রতিযোগিতা শুরু হয় এর তিন বছর পর। জাতীয় লিগ শুরু হওয়ার পরও সান্তোস ও পেলে জয়লাভ করে। ওই খেলায় তারা ৮-৪ গোলে জয়লাভ করে, সেখানে পেলে পাঁচটি গোল করেন। ওই ঘটনায় ব্রাজিলের এক দিনের জাতীয় ছুটিও ঘোষণা করা হয়। পেলে যাতে খ্যতিমান ক্লাবে যোগ না দেন, সে জন্য ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট পেলেকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে আখ্যা দেন। পেলে তাঁর পুরো ক্লাব ক্যারিয়ার সান্তোসে কাটিয়েছিলেন। তিনি ইউরোপে যাওয়ার প্রচুর অর্থের প্রলোভন পাওয়া সত্ত্বেও সেটি ত্যাগ করেছিলেন।

পেলে ছিলেন ফুটবল বিশ্বকাপের রাজা। প্রথম বিশ্বকাপের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর। ১৯৫৮ সালে সুইডেনে অনুষ্ঠিত ওই বিশ্বকাপে তিনি ছয়টি গোল করেন। এর মধ্যে দুটি করেন ফাইনালে। বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় আসরে এমন কীর্তিতে পেলের নামটি বিশ্বকাপের সমার্থক হয়ে উঠেছিল। ব্রাজিল ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালে পরপর দু’বার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এর মাধ্যমে ব্রাজিল সত্যিকার ফুটবল দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৯৫৮ সালের ফাইনালে ব্রাজিল ৫-২ গোলে সুইডেনকে হারায়। পেলে বিশ্বকাপের সবচেয়ে সেরা গোলগুলোর মধ্যে একটি গোল করেন। ৯০তম মিনিট পেলে বলকে ব্রাজিলের নিয়ন্ত্রণে রাখেন, নিজে খেলেন এবং সতীর্থ খেলোয়াড়দের কাছে পাস করেন। ডাইভ দিয়ে তিনি বল গোল পোস্টে পাঠান। অন্যরা তাঁর খেলা দেখে অবাক হয়ে যেতেন। ওই বিশ্বকাপের দ্বিতীয় গোলের কথা স্মরণ করে ফিফাকে সুইডেনের ডিফেন্ডার বলেছিলেন, ‘পেলের গোলের পর এমনকি আমি তাঁর পক্ষে উল্লাস করতে চেয়েছিলাম।’ সুইডেনের খেলোয়াড়দের সামনে থেকে তিনি অবিশ্বাস্যভাবে বলটি তাঁর খেলোয়াড়দের কাছে নিয়ে আসেন। সে দৃশ্য ছিল দেখার মতো।

১৯৫৮ এবং ১৯৬২ সালে পরপর দু’বার বিশ্বকাপ নেওয়ার পর ১৯৬৬ সালে পেলে ইনজুরিতে পড়েন। সে বছর ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হয়। আবার ১৯৭০ সালে এসে ব্রাজিল ফাইনালে ইতালিকে ৪-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। সে বছরও পেলে ব্রাজিলকে নেতৃত্ব দেন। ওই বিশ্বকাপে পেলের খেলা আরও অসাধারণ হয়ে ওঠে। বিখ্যাত হলুদ রঙের জার্সিতে ব্রাজিলের খেলা বিশ্বব্যাপী টেলিভিশন দর্শকরা প্রথমবারের মতো রঙিন টিভিতে দেখেন।

পেলে ছিলেন ‘বিশ্ব ব্র্যান্ড’ এর মতো। তিনি গোল করার ক্ষেত্রে যে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন, সেটি আজও সবর্জনবিদিত। ১৯৬৯ সালে পেলে তাঁর জীবনের ১০০০তম গোলটি করেন। পরদিন সেই খবর ও ছবি সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠা দখল করে। যদিও সেই বছরের ২০ নভেম্বর বিশ্বের সব সংবাদমাধ্যমে অ্যাপোলো ১২- চন্দ্র পৃষ্ঠে অবতরণের খবর প্রাধান্য পায়, পেলের ঘটনাটিকে অ্যাপোলো ১২-এর খবরের সময় গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে।

পেলে ১৯৯৪ সালে ব্রাজিলের খেলাবিষয়ক মন্ত্রী হন। ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যমে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি প্রশাসনিকভাবে যা করে গেছেন সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। পেলে ফুটবল খেলার যে সৌন্দর্য প্রদর্শন করে গেছেন, সেটি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। ৮২ বছরে বিশ্বকাপের রাজার মতোই তিনি বিদায় নিয়েছেন।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.