লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধে যা করবেন

মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে লিভার। বিভিন্ন কারণে লিভার ক্যান্সারের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। লিভার ক্যান্সার হচ্ছে বিশ্বে ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে জানাচ্ছেন ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী

লিভার দেহের প্রায় পাঁচ শরও বেশি কার্যসম্পাদন করে। আর এসব কাজের মাধ্যমে অনেক কিছু উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং বিশুদ্ধকরণ হয়ে থাকে। শরীরের রক্ত ফিলট্রেশনও হয়ে থাকে। লিভার তার নিজস্ব সেল (কলা), বিলিয়ারি, রক্তনালি ও সাপোর্টিং টিস্যু দ্বারা গঠিত।

প্রতিটি সেল/টিস্যু ক্যান্সারে রূপান্তরিত হতে পারে, যেগুলোকে লিভারের নিজস্ব ক্যান্সার বলে। যেহেতু শরীরের রক্ত ফিলট্রেশন হয়, তাই শরীরের যেকোনো অঙ্গেরও মেলিগন্যান্ট টিউমার (ক্যান্সার) লিভারের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। এটিকে মেটাসটেটিক টিউমার বলে।

লিভার ক্যান্সারের ব্যাপকতা

বিভিন্ন কারণে ইদানীং লিভার ক্যান্সার বৃদ্ধি পাচ্ছে। লিভার ক্যান্সার হচ্ছে বিশ্বে ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। ‘ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার’-এর তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে আট লাখ ৩০ হাজারেও বেশি মানুষ লিভার ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেছে। শনাক্ত হয়েছে ৯ লাখের বেশি নতুন লিভার ক্যান্সার রোগী। ২০৪০ সাল নাগাদ লিভার ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে, প্রায় ১৩ লাখ মানুষ এই ক্যান্সারে মারা যাবে।

বাংলাদেশে লিভার ক্যান্সারের প্রবণতা

বাংলাদেশে হেপাটাইটিস ‘বি’ প্রবণতা প্রায় ৫.৫ শতাংশ এবং হেপাটাইটিস ‘সি’ প্রায় ০.৬ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত। লিভার ক্যান্সার বাংলাদেশেও ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ।
হেপাটাইটিস ‘বি’ আক্রান্তের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ রোগের বিভিন্ন পর্যায়ে লিভার সিরোসিস, আক্রান্তদের ১০ থেকে ১৫ শতাংশের লিভার ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। হেপাটাইটিস ‘সি’ আক্রান্তদের প্রায় ২০ শতাংশের লিভার সিরোসিস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আক্রান্তদের ১৭ থেকে ৩০ শতাংশের লিভার ক্যান্সার হতে পারে।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক বিরাট অংশের হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসজনিত লিভার ক্যান্সার আক্রান্তের আশঙ্কা রয়েছে। প্রতি তিনটি লিভার ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর, দুটিই হেপাটাইটিস ‘বি’ অথবা ‘হেপাটাইটিস ‘সি’র কারণে হয়ে থাকে।

লিভার ক্যান্সারের ধরন: দুই ধরনের লিভার ক্যান্সার হয়ে থাকে-
প্রাইমারি লিভার ক্যান্সার : লিভারের বিভিন্ন কোষ অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি পেয়ে ক্যান্সার সেলে রূপান্তরিত হলে। যেমন : হেপাটোসেলুলার কারসিনোমা, কলেনজিও কারসিনোমা এবং সারকোমা।

মেটাস্টেটিক লিভার ক্যান্সার : (সেকেন্ডারি লিভার ক্যান্সার) রক্তের মাধ্যমে শরীরের অন্য অঙ্গে অথবা সরাসরি লিভারে বিস্তার লাভ করতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—কোলন, রেক্টাম, গলব্লাডার, প্যানক্রিয়াস, পাকস্থলী, ফুসফুস এবং মেলিগনেন্ট মেলানোমা।

লিভারে প্রাথমিক ক্যান্সার থেকে মেটাস্টেটিক ক্যান্সার ৩০ গুণ বেশি হয়ে থাকে।

শিশুদের লিভার ক্যান্সার

শিশুদের সবচেয়ে বেশি যে লিভার টিউমার হয় সেটিকে হেপাটোব্লাস্টোমা বলে। সাধারণত প্রথম তিন বছর বয়সে এ রোগ ছেলেশিশুদের বেশি হয়।

কারণ

♦ যেকোনো কারণে লিভার সিরোসিস অথবা দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিস হলে তা থেকে লিভার ক্যান্সার হতে পারে।

♦ হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’র কারণে দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিস ও লিভার সিরোসিস হলে লিভার ক্যান্সার হতে পারে।

♦ ফ্যাটি লিভার, এনএফএলডি, ন্যাশ সিরোসিস থেকে লিভার ক্যান্সার হয়ে থাকে, যা ইদানীং দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

♦ অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত মদ্যপানে হেপাটাইটিস, লিভার সিরোসিস থেকে লিভার ক্যান্সার হয়।

♦ মেল হরমোন, অ্যানাবলিক স্টেরয়েড, জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি একনাগাড়ে দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে লিভারসেল এডিনোমা থেকে লিভার ক্যান্সার হতে পারে।

লক্ষণ

সাধারণত প্রাথমিক অবস্থায় কোনো উপসর্গ থাকে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপসর্গবিহীনভাবে বাড়তে থাকে। উপসর্গ হচ্ছে : ক্ষুধামান্দ্য, ক্লান্তি, ওজন হ্রাস, পেটের ওপরের দিকে ব্যথা, চাকা, বমি বমি ভাব, জন্ডিস, পায়ে ও পেটে পানি আসা।

প্রতিরোধে করণীয়

১. হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’র সর্বাত্মক প্রতিরোধ :

♦ গণসচেতনতা : সাধারণ জনগণ ও গর্ভবতী মহিলা।

♦ ভ্যাকসিনেশন বা টিকাদান : নবজাতকের হেপাটাইটিস ‘বি’ ভ্যাকসিনেশন। শিশুদের, ইয়ং অ্যাডাল্ট ও রিস্ক গ্রুপকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনা। হেপাটাইটিস ‘বি’ প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন ৫০ শতাংশ, দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন ৮০ শতাংশ এবং তৃতীয় ডোজ ভ্যাকসিন প্রায় ৯৮ থেকে ১০০ শতাংশ হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস প্রতিরোধ করে।

♦ হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ আক্রান্ত রোগীদের যথার্থ চিকিৎসা ও ওষুধের ব্যবস্থা করা। এতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমবে, সমাজে বিস্তারও কমবে। আশার কথা হেপাটাইটিস ‘সি’র আরোগ্য লাভকারী ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে।

২. হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ রক্ত ও রক্তের উপাদান এবং বডি ফ্লুইডের (বীর্য, অশ্রু, মুখের লালা ইত্যাদি) মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনে সংক্রমিত হয়। নিম্নলিখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।

♦ রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসমুক্ত কি না নিশ্চিতকরণ।

♦ একবার ব্যবহার্য সিরিঞ্জ ও সুচের ব্যবহার নিশ্চিতকরণ।

♦ নিজস্ব দাঁতের ব্রাশ, রেজর, কাঁচি ইত্যাদি ব্যবহার।

♦ নিরাপদ যৌনচর্চা।

♦ হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ আক্রান্তকে কখনো রক্ত ও অঙ্গদানকারী হিসেবে নেওয়া যাবে না।

♦ নাক-কান ছিদ্র করা, ট্যাটু করার সময় একই সুচ ব্যবহার না করা।

♦ সব ধরনের সার্জারি ও দাঁতের চিকিৎসায় জীবাণুমুক্ত যন্ত্র ব্যবহার।

♦ সেলুনে একই ক্ষুর/ব্লেড ব্যবহার না করা।

৩. হেপাটাইটিস ‘বি’ আক্রান্ত মা থেকে নবজাতকের সংক্রমণই হেপাটাইটিস ‘বি’ সংক্রমণের অন্যতম প্রধান কারণ। প্রত্যেক গর্ভবতী মহিলার হেপাটাইটিস বি পরীক্ষা করা জরুরি। পজিটিভ মায়েদের চিকিৎসা এবং নবজাতককে জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টিকা (বার্থ ডোজ) এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ইম্মুনোগ্লোবিউলিন দেওয়া জরুরি। প্রত্যেক শিশুকে হেপাটাইটিস বি টিকা দেওয়া জরুরি। প্রাপ্তবয়স্ক এবং যাঁরা ঝুঁকিতে আছেন তাঁদেরও টিকা দেওয়া উচিত। হেপাটাইটিস ‘সি’র কোনো টিকা নেই, তাই সর্বাত্মক প্রতিরোধব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ প্রতিরোধ করতে পারলে ৮০ শতাংশ লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধ সম্ভব।

৪. ন্যাশ প্রতিরোধ : ফ্যাটি লিভার থেকে সৃষ্ট এনএফএলডি থেকে ন্যাশ হয়। ন্যাশ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই ডায়াবেটিস, ওজন আধিক্য, ডিসলিপিডেমিয়া, হাইপোথাইরয়েডিজম, ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধ জরুরি।

৫. মদ্যপানজনিত হেপাটাইটিস : অতিরিক্ত মদ্যপান কমিয়ে আনা অথবা বন্ধ করা উচিত। ন্যাশ ও মদ্যপানজনিত হেপাটাইটিস থেকে প্রায় ১৫ শতাংশ লিভার ক্যান্সার হয়ে থাকে।

৬. অতিরিক্ত হরমোন গ্রহণ : দীর্ঘদিন অ্যানাবলিক হরমোন এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি গ্রহণ পরিহার করা উচিত।

একনাগাড়ে পাঁচ বছরের বেশি জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি (কন্ট্রাসেপটিভ পিল) গ্রহণে লিভারসেল অ্যাডিনোমা হতে পারে, যা থেকে লিভার ক্যান্সার হতে পারে। আর্সেনিকমুক্ত পানি পান করা এবং আলফাটক্সিনমুক্ত খাবার খাওয়া জরুরি।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.