সিত্রাং এর তাণ্ডব

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত দেশের ১৬ জেলায় ৩৫ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। সেখানকার সন্দ্বীপ চ্যানেলে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে তীব্র বাতাস ও ঢেউয়ে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ভোলায় গাছচাপা পড়ে ও পানিতে ডুবে চারজনের প্রাণহানি হয়েছে। কুমিল্লায় গাছচাপা পড়ে বাবা-মা ও সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। টাঙ্গাইলে ঝড়ের কবলে পড়ে মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় দুই পুলিশ সদস্য ও এক আসামির মৃত্যু হয়েছে। তবে সরকারি হিসাবে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত এ ঝড়ের তাণ্ডবে ৯ জনের প্রাণহানির কথা বলা হয়েছে।

এছাড়া সারা দেশে ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন। এতে প্রায় ৮০ লাখ গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে বিদ্যুৎহীন অবস্থায় ছিল প্রায় ৩ কোটি মানুষ।

বুধবারের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হতে পারে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

মঙ্গলবার দুপুরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান সচিবালয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে বলেন, শুকরিয়া- এটা ঘূর্ণিঝড় পর্যন্ত ছিল, কোনো সুপার সাইক্লোনে রূপান্তরিত হয়নি। বাতাসের গতিবেগ ৮০ কিলোমিটারের উপরে যায়নি। ঘূর্ণিঝড়টি ভোলা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ৪১৯ ইউনিয়নের ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এক হাজার মৎস্য ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারের তরফ থেকে ঘর মেরামতের জন্য টিন দেয়া হবে। আর যাদের মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা সুদমুক্ত ঋণ পাবেন। ঘূর্ণিঝড়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মোট নয়জনের মৃত্যুর তথ্য দেন প্রতিমন্ত্রী। দুর্যোগে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

এনামুর রহমান জানান, দেশের ৬ হাজার ৯২৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১০ লাখ লোক আশ্রয় নিয়েছিলেন ঝড়ের সময়। ঝড় কেটে যাওয়ার পর তারা সবাই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়েছেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কিছু স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে, তবে এখন স্বাভাবিক হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্রে জানা গেছে, সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন সড়কে ২৮৭টি গাছ ভেঙে পড়ার তথ্য তারা পেয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন সড়কে ৫৬টি গাছ উপড়ে পড়েছে। তিনটি ঘটনায় গাছ পড়েছে বাসা বাড়ির ওপর। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সেসব গাছ সরিয়ে ফেলেছেন। দুর্ঘটনা ঘটেছে দু’টি, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আছে ১৭টি।

সোমবার রাত ১০ টার দিকে রাজধানীর জিরো পয়েন্টে সচিবালয়ের দিকে একটি বড় গাছ ভেঙে পড়ে। গাছ ভেঙে পড়ে রাস্তার অনেকটা অংশ বন্ধ হয়ে যায়। এতে ওই সড়কে যান চলাচল বিঘ্নিত হয়। পুলিশ গাড়িগুলোকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেয়। রমনা ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) জয়নুল আবেদীন জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’য়ের প্রভাবে রমনা ট্রাফিক এলাকার অন্তত ২৫ স্থানে গাছ ভেঙে পড়েছিল। খবর পাওয়ার পর থেকে খুব দ্রুতই সেগুলোকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সোমবার রাতে শান্তিনগর পুলিশ লাইনের বিপরীতে ডিটিএস’র সামনে একটি বড় গাছ পড়ে যায়। পরে গাছটি সরানো হয়। গুলিস্তানের মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামের সীমানার ভেতরে বড় একটি গাছ ভেঙে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

রাত ১১টার দিকে যাত্রাবাড়ীর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রায়েরবাগ বাস স্টপেজের কাছে উত্তর রায়েরবাগে প্রবেশের মুখে বাঁশের একটি তোরণ ভেঙে পড়ে যায়। গুলশান ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার রবিউল ইসলাম জানান, ইসিবি চত্বর, গুলশান-২ থেকে নতুন বাজার রুটে বড় গাছ পড়েছিল। আমরা ৩০ টি স্থানে গাছ অপসারণ করেছি। তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) সাহেদ আল মাসুদ জানান, তেজগাঁও এলাকায় অন্তত ৩০ স্থানে গাছ পড়েছে।

মোহাম্মদপুর, ঢাকা উদ্যান, শ্যামলী, আদাবর, তাজমহল রোড, আগারগাঁও সহ বেশকিছু সড়কে পড়ে থাকা গাছ ও ডালপালা অপসারণ করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া জানান, সোমবার সন্ধ্যায় হাজারীবাগের মনেশ্বর রোডে ঝড়ের সময় দেয়াল চাপায় অজ্ঞাত এক রিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে শেষ বিকালে ঝোড়ো বাতাস ছিল প্রবল। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের অগ্রভাগ সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানে। মূল কেন্দ্র উপকূলে আঘাত হানে রাত ন’টায়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ঝোড়ো বাতাস ও বৃষ্টি হয়। ঝোড়ো বাতাসে অনেক জায়গায় বিদ্যুতের খুঁটি ও সঞ্চালন লাইনের ক্ষতি হয়। অনেক এলাকা বিদ্যুৎ ুবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ঘূর্ণিঝড়টি চলে যাওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ ফিরতে শুরু করে।

৩ কোটির বেশি মানুষ বিদ্যুৎহীন: সিত্রাংয়ের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৮০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এর মধ্যে ৬০ লাখ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের গ্রাহক। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে তিন কোটির বেশি মানুষ এখন বিদ্যুৎহীন অবস্থায় আছে।

গতকাল সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে কত গ্রাহক এখন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন? এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের প্রায় ৪ কোটি ৮০ লাখের মতো গ্রাহক। এখন প্রায় ৮০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। আরইবি’র (পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড) আট শতাধিক পোল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পিডিবিসহ সবমিলিয়ে প্রায় দেড়-দুই হাজার পোল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, মঙ্গলবার বিকালের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রাহকের বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে পারবো। ট্রান্সমিশনে আমাদের খুব বড় রকমের আঘাত হয়নি। বড় ধরনের আঘাত হয়েছে ডিস্ট্রিবিউশনের ক্ষেত্রে। সেখানে তার ছিঁড়ে গেছে। গাছ উপড়ে গিয়ে লাইনের ক্ষতি করেছে। অনেক জায়গায় পোল (বিদ্যুতের খুঁটি) পড়ে গেছে, ভেঙে গেছে। অনেক জায়গায় সমস্যা দেখা গেছে।

সম্পূর্ণ সমাধান হতে কতদিন লাগবে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা বুধবার দুপুরের মধ্যে শতভাগ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবো বলে আশা করছি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের কর্মীরা কাজ করছেন, বিশেষ করে আরইবি ঝড় শুরু হওয়ার পর থেকেই সজাগ ছিল। এখন ২৪ ঘণ্টা তারা কাজে নিয়োজিত আছেন, বিশেষ করে আরইবি ও পিডিবি। ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে সাবস্টেশনগুলোতে পানি উঠে গেছে।

লোডশেডিং নিয়ে করা এক প্রশ্নের উত্তরে নসরুল হামিদ বলেন, এখন লোডের পরিমাণ কম। আমরা আশা করছি যে এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব বের হয়ে আসার। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম কত দ্রুত লোডশেডিং থেকে বেরিয়ে আসতে পারি সে ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করে যাচ্ছি। আমরা আশা করছি কয়েক মাসের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবো। দিনের বেলায় বিদ্যুৎ ব্যবহার না করার বিষয়ে যে কথা আসছে, তাতে মানুষের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে এমন কথা বলা হলে তার উত্তরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, যে কথাটা আসছে শঙ্কার ভিত্তিতে। যদি দেশের অবস্থা, সারা বিশ্বের অবস্থা খুব খারাপের দিকে যায় সেক্ষেত্রে তাদের কথা মনে হয়। তবে আমি মনে করি এত শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা চেষ্টায় আছি ভালো অবস্থায় যাবো। আমাদের সব পরিস্থিতি সামাল দিয়ে সামনে এগোতে হবে। এটাই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আমি মনে করি আমরা এটা সামাল দিতে পারবো।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.