‘শিল্প, জ্বালানি, পরিবহনে বেশি করে বিনিয়োগ করুন’

ভারতীয় ব্যবসায়ীদের প্রধানমন্ত্রী

শিল্প উৎপাদন, জ্বালানি, অবকাঠামো ও পরিবহন খাতে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে আরও বেশি করে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিস্তৃত সুযোগ-সুবিধা, আকর্ষণীয় প্রণোদনা নীতি, ধারাবাহিক সংস্কারসহ সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ ব্যবস্থা থাকায় বাংলাদেশ বিনিয়োগের আকর্ষণীয় কেন্দ্র বলেও ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করেছেন তিনি।

বুধবার সকালে নয়াদিল্লির আইসিটি মৌর্য হোটেলে বাংলাদেশ-ভারত ব্যবসায়িক ফোরাম অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রীসহ দুই দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা এতে উপস্থিত ছিলেন। এই আয়োজন করে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) এবং ভারতের কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়া ইন্ডাস্ট্রি (সিআইআই)।

দুই দেশের ব্যবসায়িক ফোরামের সভায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্প, উৎপাদন, জ্বালানি ও পরিবহন খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা বিবেচনায় নিতে পারেন। সময়, খরচ ও সম্পদ বাঁচাতে ‘বাই-ব্যাক’ চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে শিল্প গড়ে তুলতে পারেন।

তিনি বলেন, ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য মোংলা ও মিরসরাইয়ে দুটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। শুধু ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে নয়, নেপাল-ভুটান এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সুবিধা নিতে পারেন ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে বর্তমানে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ২৮টি হাই-টেক পার্ক বাংলাদেশজুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে। যাতে বাংলাদেশ শিল্পের বৈচিত্র্যকরণ, কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও রপ্তানির মাধ্যমে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে।

বাংলাদেশ ও ভারতের সুসম্পর্ক দুই দেশের প্রতিবেশী কূটনীতিতে রোল মডেল বলে অবহিত করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কম খরচ ও বিশাল ভোক্তার বাজার সুবিধা বিবেচনায় ভারতীয় ব্যবসায়ীদের এখনই বিনিয়োগ করার সময়। বাংলাদেশে মেগা প্রকল্পগুলো শিল্পের প্রবৃদ্ধিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানের সুফল নিতে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিক অংশীদার। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পর্যটক ও রোগী ভারতে চিকিৎসা নিতে যান। সেই সঙ্গে ভারতীয়রা বাংলাদেশে কাজ করছেন। তাঁরা দুই দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও গভীর ও উন্নত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, অভিন্ন সমৃদ্ধি এবং দুই দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য দুই দেশের ব্যবসায়ীদের ভূমিকা পালন করতে হবে। এভাবেই আমরা এ অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি আনতে পারব।

এ ধরনের অনুষ্ঠান দুই দেশের ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে আলোচনা ও ভাবনা বিনিময়ের সুযোগ করে দেয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, দুই দেশের নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ীদের সফলতার জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, অগ্রাধিকার, সম্ভাবনা নিয়ে মতবিনিময় জরুরি। এ অনুষ্ঠানে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রতিফলিত হবে। কোনো সন্দেহ নেই, করোনার কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ নিত্যপণ্য এবং জ্বালানি তেলের দাম বিশ্বজুড়ে বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে বিদ্যমান সরবরাহ ব্যবস্থা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। চলমান বাধাগুলো সত্ত্বেও ভারত বিশ্বের অন্যতম দ্রুত প্রবৃদ্ধির একটি প্রধান অর্থনীতি।

শেখ হাসিনা বলেন, অনেক বিশেষজ্ঞ ধারণা করেছেন, ভারতের অর্থনীতি ২০৫০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর বিশ্বে তৃতীয় স্থানে পৌঁছবে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ভারতে ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে ধারণা করেছে।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলার পথে বাংলাদেশও অনেক দূর এগিয়েছে। সেই দিনগুলোতে দুর্ভিক্ষ এবং খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভরশীল দেশ আজকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ্বে চাল, সবজি, খাদ্য এবং মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে অন্যতম বড় উৎপাদক এখন বাংলাদেশ। আগে বিশ্বের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত থাকলেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ এখন উদাহরণ। আর্থসামাজিক খাতেও বাংলাদেশের বেশ কিছু অর্জন রয়েছে বলে অনুষ্ঠানে জানান তিনি।

অন্য দেশ থেকে বেশি দামে পণ্য না কিনে বাংলাদেশ থেকে উন্নতমানের পণ্য কম মূল্যে সংগ্রহ করতে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ১৩৭ কোটি ডলারের বিনিয়োগ বাংলাদেশে এসেছে। এর মধ্যে মাত্র ১ দশমিক ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ এসেছে ভারত থেকে।

অনুষ্ঠানে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, এ সেতু হওয়ায় দক্ষিণের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশের দেশজ প্রবৃদ্ধি ২ থেকে ৩ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। গত এক দশকে এ ধরনের অনেক অবকাঠামোগত প্রকল্প বাংলাদেশ হাতে নিয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। এ সময়ে মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালসহ বেশ কিছু মেগা প্রকল্পের উদাহরণ দেন তিনি।

বিকেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া যুদ্ধাহত ভারতীয় সৈনিকদের পরিবারের সদস্যদের ‘মুজিব স্কলারশিপ’ প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারিত্বের অনেক ওপরে চলে গেছে। গত এক দশকে এ সম্পর্ক আরও মজবুত হয়েছে। দুই দেশ নিজেদের মধ্যকার অমীমাংসিত বিষয়গুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করেছে। সমুদ্রসীমা ও স্থল সীমান্ত চুক্তি এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ৫০ বছর ধরে উভয় দেশ শক্তিশালী অংশীদারিত্বের মাধ্যমে খাতভিত্তিক সহযোগিতা বাড়িয়েছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত এবং এ দেশের মানুষ যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, তা আমরা কখনোই ভুলব না। আমি চাই, আমাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকুক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যাঁরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন, সেই নায়কদের সম্মানে এ মুজিব বৃত্তি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার প্রতীক।

এ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মুজিব বৃত্তি দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, দুই দেশের যে সুসম্পর্ক রয়েছে, ভবিষ্যতে তা আরও গভীর হবে।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.