বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার মুখে

তিন মাসে ৭১ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যে

করোনা মহামারি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে এ বছরটি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য হতে পারত মাইলফলক। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে সংকটে রূপ দিল ছয় মাস অতিবাহিত হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের ওপর হামলা শুরু করে রাশিয়া। জ্বালানি ও কৃষিপণ্যে গুরুত্বপূর্ণ এই দুই দেশ।

ফলে সে দিন থেকেই অস্থির হয়ে ওঠে বিশ্ববাজার। তেল-গ্যাস, খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। যুদ্ধের কবলে পড়ে বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমেই খেই হারাতে শুরু করে। বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসে বারবার কমাতে থাকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এখন আশা করছে, বিশ্ব প্রবৃদ্ধি হবে ৩.২ শতাংশ। যেখানে বছরের শুরুতে পূর্বাভাস ছিল প্রবৃদ্ধি আসবে প্রায় ৫ শতাংশ।
ওইসিডির হিসাবে বৈশ্বিক উৎপাদন ও বাণিজ্যের মাত্র ২ শতাংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। কিন্তু রাশিয়া হচ্ছে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কৃষিপণ্যের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশ। একইভাবে উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশ ইউক্রেনের খাদ্যশস্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ইউরোপের রুটির ঝুঁড়ি বলা হয় এ দেশটিকে। যুদ্ধের কারণে এসব পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হয় এবং জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো।

যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে চার দশকে সর্বোচ্চ হয়। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ঘন ঘন সুদের হার বাড়াতে থাকে, যা প্রকারান্তরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শ্লথ করে দেয়।

তিউনিশিয়ায় স্বল্প আয়ের মানুষ যেন দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে—বললেন ৭০ বছর বয়সী সাবেক নার্স নায়মা দেগাবি। তিনি বলেন, ‘প্রায় সব কিছুর দামই বাড়ছে। সবজি-ফল, মাংসসহ সব কিছুর দামই তিন গুণ বেড়েছে। ’

প্রায় ১১ হাজার কিলোমিটার দূরে চিলির শহর ভালপারাইসোতে বসবাস করেন ৩৩ বছর বয়সী সমাজকর্মী নায়িব পিনেরা। তিনি জানান, ‘সব কিছুর দাম অনেক বেশি বেড়েছে। ’ বলেন, ‘পেট্রলের দাম প্রতি লিটারে বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৩০০ পেসো (প্রতি গ্যালন ৫.৫০ ডলার)। প্রায় ইউরোপীয়দের সমান জ্বালানি ব্যয়। অন্যদিকে রাশিয়া থেকে গ্যাস আসবে কি না—এমন উদ্বেগে ইউরোপে ব্যাপকভাবে বেড়েছে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম। বেড়েছে জ্বালানি তেলের দামও। এতে পণ্য পরিবহন খরচও বেড়ে যায় ব্যাপকভাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ এ বছর চার দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। সুদের হার বাড়ানোয়, শক্তিশালী হচ্ছে ডলার। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রার ব্যাপক দরপতন হচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি আরো অসহনীয় করে তুলছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের উন্নত ও উদীয়মান বেশির ভাগ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু জুলাই মাসেই প্রায় এক হাজার ২০০ বেসিস পয়েন্ট সুদের হার বাড়িয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির এই ধারা থেকে এটা স্পষ্ট, বিশ্ব অর্থনীতি আবারও সংকোচনের দিকে এগোচ্ছে। আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ পিয়েরে-ওলিভিয়ার গোরিনকাস বলেন, ‘বিশ্ব সম্ভবত একটি মন্দার প্রান্তে চলে এসেছে। সর্বশেষ মন্দার দুই বছর পরই আবার হোঁচট খেল অর্থনীতি। ’

পাকিস্তানে ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মান ৩০ শতাংশ পর্যন্ত পড়েছে। দেশটির সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে ৫০ শতাংশ। আমদানিকারক শাকিল বলেন, ‘বিভিন্ন দেশ থেকে এখন আমাদের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি দামে পণ্য আমদানি করতে হয়। ’

ইউএন ডেভেলপমেন্ট প্রগ্রাম জানায়, খাদ্য ও জ্বালানির দাম বাড়ায় যুদ্ধের প্রথম তিন মাসে বিশ্বে ৭১ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যে নিপতিত হয়। এফএও পূর্বাভাসে জানায়, এ বছর ৪১ দেশের ১৮১ মিলিয়ন মানুষ খাদ্যসংকটে পড়তে পারে। সবচেয়ে বেশি ভুগছে বলকান ও সাব-সাহারা আফ্রিকার দেশগুলো। সূত্র : এএফপি, ডানভের পোস্ট

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.