ভোজ্যতেলের চাহিদার ৫০ ভাগ দেশেই উৎপাদন সম্ভব!
বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৫০ ভাগ তেল দেশেই উৎপাদন সম্ভব হবে। ধানের কুঁড়া থেকে তৈরি রাইস ব্রান অয়েল দিয়ে এ চাহিদা মেটানো যাবে। এতে এক দিকে আমদানিনির্ভরতা কমবে পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্র্রতিষ্ঠান কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে বছরে প্রায় ১৩-১৪ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ তেল আমদানি করা হয়। বাকি ৫ শতাংশ অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদন হয়। ধানের কুঁড়া থেকে তেল উৎপাদনের উদ্যোগ নিলে বছরে সাড়ে ছয় থেকে সাত লাখ টন তেল দেশেই উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এতে বলা হয়, সয়াবিন তেলের পাশাপাশি মানুষ এখন রাইস ব্রান অয়েলের দিকে ঝুঁকছে। কারণে এটি সয়াবিনের চেয়ে বেশি স্বাস্থ্যকর। এ কারণে দেশে রাইস ব্রান অয়েল উৎপাদন বাড়াতে হবে। আর বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৭ হাজারের বেশি রাইস মিল রয়েছে। এর মধ্যে ৬০০টি অটোরাইস মিল এবং ৪০০টি সেমি অটোরাইস মিল। বাকিগুলো ম্যানুয়াল পদ্ধতির রাইস মিল। প্রতিটি অটোরাইস মিল থেকে প্রতিদিন গড়ে ছয় টন ধানের কুঁড়া উৎপন্ন হয়। সে হিসাবে ৬০০ অটোরাইস মিল থেকে দিনে তিন হাজার ৬০০ টন ধানের কুঁড়া উৎপন্ন হয়। এ হিসাবে বছরে অটোরাইস মিল থেকে ১৩ লাখ ১৪ হাজার টন ধানের কুঁড়া উৎপন্ন হয়।
অন্যদিকে প্রতিটি সেমি অটোরাইস মিলে প্রতিদিন গড়ে ৩ দশমিক ৮০ টন চালের কুঁড়া উৎপন্ন হয়। সে হিসাবে ৪০০টি সেমি অটোরাইস মিল থেকে বছরে পাঁচ লাখ ৫৪ হাজার ৪০০ টন ধানের কুঁড়া উৎপন্ন হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ১৬ হাজার সাধারণ রাইস মিল। প্রতিটি সাধারণ রাইস মিল থেকে প্রতিদিন গড়ে এক টন ধানের কুঁড়া উৎপন্ন হয়। সে হিসাবে প্রতিদিন এসব সাধারণ রাইস মিল থেকে ১৬ হাজার টন ধানের কুঁড়া উৎপন্ন হচ্ছে। সে হিসাবে বছরে ২৮ লাখ ৮০ হাজার টন কুঁড়া উৎপন্ন হচ্ছে। আর সবমিলে দেশে বছরে কুঁড়া ৪৭ লাখ ৪৮ হাজার ৪০০ টন উৎপন্ন হচ্ছে।
ধানের কুঁড়াকে তেলের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে-পালিস, সেমি অটো পালিস, নোটিং পালিস ও চাকি। পালিসে শতকরা ২৫-২৬ শতাংশ, সেমি অটো পালিসে ১৬-১৮ শতাংশ, নোটিং পালিসে ১৪-১৫ শতাংশ এবং চাকিতে ৮-১০ শতাংশ তেল পাওয়া যায়। এ হিসাবে ধানের কুঁড়া থেকে বছরে সাত লাখ ১০ হাজার ৮১৬ টন ভোজ্যতেল উৎপাদন করা সম্ভব। উৎপাদিত এ তেল দিয়ে দেশের চাহিদার ৫০ শতাংশ মেটানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ৬-৭ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানির প্রয়োজন হবে না।
প্রতিবেদনে বলা হয়-দেশে স্থাপিত প্রায় ১৭ হাজার রাইস মিলকে সরকারি ও বেসরকারি উপায়ে ধানের কুঁড়া দিয়ে তেল উৎপাদনে উপযোগী করা গেলে বছরে প্রায় ২২ লাখ টন ভোজ্যতেল উৎপাদন করা সম্ভব। তখন সারা দেশের ধানের কুঁড়াকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা যাবে। তখন এ তেল থেকে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করাও সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ধানের কুঁড়া দিয়ে তেল উৎপাদন নিয়ে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একটি গবেষণা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দেশে যে পরিমাণ ধানের কুঁড়া উৎপন্ন হয় তা থেকে দেশের চাহিদার অর্ধেক তেল উৎপাদন করা সম্ভব। গবেষণাটি আরও আপডেট করা হচ্ছে। ৮ ঘণ্টার মধ্যে ধানের কুঁড়া থেকে তেল না বের করা হলে তা নষ্ট হয়ে যায়।
গবেষণায় যে পরিমাণ তেল উৎপাদন হবে বলে উল্লেখ আছে তা আরও আপডেট হবে। তখন কুঁড়া দিয়ে কী পরিমাণ তেল উৎপাদন করা সম্ভব হবে তা আরও ভালোভাবে জানা যাবে। এ নিয়ে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কাজ চলছে।
রাইস ব্রান অয়েল উৎপাদন প্রতিষ্ঠান মজুমদার ব্রান অয়েল মিলস লিমিটেডের পরিচালক অর্জুন মজুমদার জানান, বাড়তি দামের নেতিবাচক প্রভাবে সয়াবিনের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে রাইস ব্রান। তিনি বলেন, প্রতি লিটার রাইস ব্রান অয়েল উৎপাদনে ১৪০-১৫০ টাকা খরচ পড়ে। এটা খুচরা বাজারে কোম্পানি ভেদে ১৬০ টাকায় বিক্রি করা হয়। তিনি আরও বলেন, দেশে অনেক দিন ধরে মানুষ রান্নার কাজে সয়াবিনের তেল ব্যবহার করে আসছে। অভ্যাস বদল করতে ভোক্তার সময় লাগবে।
বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা (বিসিএসআইআর) সূত্র জানায়, ভোজ্যতেলে যেসব খাদ্যগুণ থাকা উচিত তা জলপাই তেলের পর সবচেয়ে বেশি রয়েছে রাইস ব্রান অয়েলে। এতে পর্যাপ্ত ভিটামিন ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট আছে। এ ছাড়া এ তেল শরীরের কোলস্টেরলের মাত্রা কমায়। নানা ধরনের রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। রোগ প্রতিরোধী শক্তিকে উন্নত করে ফ্রি-র্যাডিক্যালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
সাম্প্রতিক সময় সরিষা ও তেলবীজ চাষ সম্প্রসারণ এবং ভোজ্যতেলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভবিষ্যৎ করণীয় বিষয়ে এক সভায় কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, দেশে মাথাপিছু তেলের ব্যবহার বাড়ছে। এ চাহিদা মেটাতে দেশিয় ভোজ্যতেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য ধানের কুঁড়া থেকে তৈরি ভোজ্যতেলের (রাইস ব্রান অয়েল) ও সরিষা চাষ বাড়িয়ে অভ্যন্তীরণভাবে তেল উৎপাদনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।