সড়ক আইন: জেনে নিন কোন অপরাধের শাস্তি কি…
যুগান্তরঃ কার্যকর হয়েছে নতুন ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’। বহুল আলোচিত এই আইনটি প্রণয়নের এক বছরেরও বেশি সময় পর এটি বাস্তবায়ন শুরু হলো। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বাধার মুখে এতদিন আইনটি বাস্তবায়নে যায়নি সরকার।
২২ অক্টোবর আইনটি কার্যকরের তারিখ ঘোষণা করে গেজেট জারি করে সরকার। নতুন আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। সড়কে আইন লঙ্ঘন করলে আজ থেকেই নতুন আইনে সাজা দেয়া হবে।
নতুন এ আইনে সব ধরনের সাজা বাড়ানো হয়েছে। নতুন আইনে ট্রাফিক সংকেত ভঙ্গের জরিমানা ৫০০ থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১০ হাজার, হেলমেট না পরলে জরিমানা ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে। সিটবেল্ট না বাঁধলে, মোবাইল ফোনে কথা বললে চালকের সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে।
বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে কাউকে আহত করলে তিন লাখ টাকা জরিমানা ও তিন বছরের জেল হতে পারে। নতুন আইনে চালকদের লাইসেন্স পেতে অষ্টম শ্রেণি, সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণি পাস হতে হবে।
ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিপরীতে ১২ পয়েন্ট রাখা হয়েছে। আইন ভঙ্গে জেল-জরিমানা ছাড়াও লাইসেন্সের পয়েন্ট কাটা যাবে। পুরো ১২ পয়েন্ট কাটা গেলে লাইসেন্স বাতিল।
চালক ও তার সহকারীকে নিয়োগপত্র দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
গণপরিবহনে ভাড়ার চার্ট প্রদর্শন না করলে বা অতিরিক্ত ভাড়া দাবি কিংবা আদায় করলে এক মাসের জেল বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা এমনকি চালকের ১ পয়েন্ট কাটা যাবে।
কনট্রাক্ট ক্যারিজের মিটার অবৈধভাবে পরিবর্তন বা অতিরিক্ত ভাড়া দাবি বা আদায় সংক্রান্ত ধারা ৩৫ এর বিধান লঙ্ঘনের দণ্ড- যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ৩৫ এর বিধান লঙ্ঘন করেন, এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষসূচক ১ পয়েন্ট কাটা হবে।
কন্ডাক্টর লাইসেন্স ছাড়া কোনো গণপরিবহণে কন্ডাক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন সংক্রান্ত ধারা ১৪ এর বিধান লঙ্ঘনের দণ্ড- যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ১৪ এর বিধান লঙ্ঘন করেন, এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ এক মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
মোটরযান রেজিস্ট্রেশন ছাড়া মোটরযান চালনা সংক্রান্ত ধারা ১৬ এর বিধান লঙ্ঘনের দণ্ড- যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ১৬ এর বিধান লঙ্ঘন করেন, এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার ও প্রদর্শনে বিধি-নিষেধ সংক্রান্ত ধারা ১৭ এর বিধান লঙ্ঘনের দণ্ড- যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ১৭ এর বিধান লঙ্ঘন করেন, এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ দুই বছর তবে কমপক্ষে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা তবে কমপক্ষে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
মোটরযানের মালিকানা পরিবর্তন বা হস্তান্তরের কারণে হস্তান্তর গ্রহীতার রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত ধারা ২১ এর বিধান লঙ্ঘনের দণ্ড- যদি কোনো হস্তান্তর গ্রহীতা ধারা ২১ এর বিধান লঙ্ঘন করেন, এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ এক মাস কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
মোটরযানের ফিটনেস সনদ ছাড়া বা মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেস সনদ ব্যবহার করে বা ইকোনমিক লাইফ অতিক্রান্ত বা ফিটনেসের অনুপযোগী, ঝুঁকিপূর্ণ মোটরযান চালনা সংক্রান্ত ধারা ২৫ এর বিধান লঙ্ঘনের দণ্ড- যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ২৫ এর বিধান লঙ্ঘন করেন, এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ট্যাক্স-টোকেন ছাড়া বা মেয়াদোত্তীর্ণ ট্যাক্স-টোকেন ব্যবহার করে মোটরযান চালনা সংক্রান্ত ধারা ২৬ এর বিধান লঙ্ঘনের দণ্ড- যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ২৬ এর বিধান লঙ্ঘন করেন, এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
রুট পারমিট ছাড়া পাবলিক প্লেসে পরিবহন যান ব্যবহার সংক্রান্ত ধারা ২৮ এর বিধান লঙ্ঘনের দণ্ড- যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ২৮ এর উপ-ধারা (১) এর বিধান লঙ্ঘন করেন, এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
বিদেশি নাগরিকের বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিজ দেশের মোটরযান/গণপরিবহণের রুট পারমিট গ্রহণ না করা সংক্রান্ত ধারা ২৯ এর বিধান লঙ্ঘনের দণ্ড- যদি কোনো বিদেশি নাগরিক ধারা ২৯ এর বিধান লঙ্ঘন করেন, এজন্য তিনি সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
মোটরযানের বাণিজ্যিক ব্যবহার সংক্রান্ত ধারা ৩১ এর বিধান লঙ্ঘনের দণ্ড- যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ৩১ এর বিধান লঙ্ঘন করেন, এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষসূচক ১ পয়েন্ট কাটা হবে।
গণপরিবহনে ভাড়ার চার্ট প্রদর্শন ও নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া দাবি বা আদায় সংক্রান্ত ধারা ৩৪ এর বিধান লঙ্ঘনের দণ্ড- যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ৩৪ এর উপ-ধারা (৩) ও (৪) এর বিধান লঙ্ঘন করেন, এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ এক মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষসূচক ১ পয়েন্ট কাটা হবে।
নতুন আইন প্রসঙ্গে বিআরটিএ চেয়ারম্যান ড. মো. কামরুল আহসান বলেন, আইন প্রয়োগে প্রথমদিকে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। তা ধীরে ধীরে কেটে যাবে। আইনের উদ্দেশ্য ঢালাও সাজা দেয়া নয়, সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা।
গত বছর ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বেপরোয়া বাসচাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহতের পর রাস্তায় নেমে আসে শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের মুখে ওই বছর ৫ আগস্ট মন্ত্রিসভার অনুমোদন পায় সড়ক পরিবহন আইন। ওই বছর সেপ্টেম্বরে সংসদে পাসের পর গত ৮ অক্টোবর গেজেট প্রকাশ পায়।
আইন কার্যকর উপলক্ষে বৃহস্পতিবার মানিকমিয়া এভিনিউতে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত চলে রোড শো। নতুন আইনের ধারা ও শাস্তি তুলে ধরে প্রচারপত্র বিলি করা হয়।
এই আইনকে ভালোভাবে মেনে নিতে পারছে না মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো। তারা বিধিমালা প্রণয়ন ছাড়া আইন কার্যকর নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন। এছাড়া বৃহস্পতিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ফেডারেশনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন। তিনি সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত ধারায় জামিনযোগ্য বিধান অন্তর্ভুক্তিসহ ৫ দফা দাবি জানিয়ে বলেছেন, শুধু ভয় দেখিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা আনা যাবে না।
শাজাহান খান যে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন সেগুলো হচ্ছে- সড়ক দুর্ঘটনার মামলাকে জামিনযোগ্য করতে হবে, তদন্ত ছাড়া দুর্ঘটনা মামলা ৩০২ ধারায় করা যাবে না, স্পর্শকাতর সড়ক দুর্ঘটনা মামলা নিরপেক্ষতার স্বার্থে পুলিশ ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের যৌথ উদ্যোগে তদন্ত করতে হবে, সড়ক আইন কমাতে ১১১টি সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর কতিপয় ধারা সংশোধনের জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে, পণ্যবাহী গাড়িতে লোডিং পয়েন্টে চেক করার ব্যবস্থা করতে হবে।