মোবাইল ফোনে প্রথম কথা বলেছিলেন কারা?
আধুনিক কালের প্রযুক্তিতে যেসব আবিষ্কার মানুষের জীবনকে সবচাইতে বেশি প্রভাবিত করেছে – তার মধ্যে মোবাইল ফোন বা সেল ফোনের সাথে হয়তো আর কোন কিছুরই তুলনা চলে না।
কিন্তু মোবাইল ফোন প্রথম তৈরি করেছিলেন কে? এতে প্রথম কথা বলেছিলেন কারা?
প্রথম মোবাইল ফোন তৈরি হয়েছিল ১৯৭৩ সালে, আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে – আর তা তৈরি করেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মার্টিন কুপার। তাকেই বলা হয় মোবাইল ফোনের জনক।
মার্টিন কুপার কাজ করতেন তখনকার এক ছোট টেলিকম কোম্পানি মোটরোলায়। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল: এমন একদিন আসবে যখন সবার হাতেই তার নিজস্ব ফোন থাকবে, আর সেই ফোনে যে কোন সময় তার সাথে যোগাযোগ করা যাবে।
বিবিসির লুইস হিদালগোকে মার্টিন কুপার বলছিলেন, সাধারণ মানুষের কাছে এ গল্প বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো শোনাবে।
“কারণ, এর আগের একশ’ বছর ধরে টেলিফোন মানেই ছিল এমন একটা জিনিস – যা আমাদের কাজের টেবিল বা বাড়িতে একটা তারের সাথে যুক্ত। বলতে পারেন এটা একটা কুকুরের গলার শেকলের মতোই। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছিল, মানুষ আসলে মৌলিকভাবেই চলিষ্ণু এবং সে যেখানেই থাকুক না কেন – সবসময়ই অন্যদের সাথে যুক্ত থাকবে। কাজেই আমাদের সেই যন্ত্র তৈরি করতে হবে যা আগে কখনো তৈরি হয় নি। এবং ঠিক সেই জিনিসটাই আমরা বানিয়ে ফেললাম – মাত্র তিন মাসের মধ্যে। ”
অনেকেই বলেন, উনিশশ’ ষাটের দশকে স্টারট্রেক নামের টিভি শোর চরিত্ররা কমিউনিকেটর নামে যে ছোট হাতে ধরা জিনিসটি ব্যবহার করতেন – সেটাই মার্টিন কুপারকে মোবাইল ফোন বানাতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
কিন্তু মার্টিন বলেন, তা নয় – বরং আমেরিকান কমিক স্ট্রিপ ডিক ট্রেসি চরিত্রেরা পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগের জন্য হাতঘড়ির মতো যে টু ওয়ে রিস্ট রেডিও ব্যবহার করতেন – সেটা দেখেই আসলে তাদের মাথায় প্রথম মোবাইল ফোনের চিন্তাটা এসেছিল।
“আগে যখন আপনি ফোন করতেন – তখন আপনার কলটা যাচ্ছে আসলে অন্য একটা জায়গায়, কিন্তু এখন মোবাইলে কল করলে তা ধরছেন একজন ব্যক্তি – যাকে আপনি ফোন করেছেন। জায়গাটা আর কোন ব্যাপার নয়। এটা একটা অত্যন্ত মৌলিক এবং গভীর পরিবর্তন।”
মার্টিন কুপার এবং তার দল প্রথম হাতে-ধরা ফোনের প্রোটোটাইপটি উপস্থাপন করেছিলেন ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে, নিউইয়র্কের হিলটন হোটেলে। সেটা কিন্তু দেখতে ছিল একেবারেই অন্যরকম। সায়েন্স ফিকশনের কমিউনিকেটর বা এ যুগের মোবাইলের সাথে তার কোন মিলই ছিল না।
সেই প্রথম মোবাইল ফোন ছিল ১০ ইঞ্চি লম্বা, দু ইঞ্চি চওড়া, এবং ৪ ইঞ্চি উঁচু। জিনিসটা ছিল অনেক ভারি। ওজন এক কিলোরও বেশি। মাত্র ২০ মিনিট কথা বললেই তার ব্যাটারি শেষ হয়ে যেতো। সেই ফোন দেখে লোকে হেসেছিল। কিন্তু তখনকার দিনে এর চেয়ে ভালো কিছু তৈরি করা সম্ভব ছিল না।
মার্টিন কুপারকে মোটরোলা কোম্পানিতে একটা গল্প বলা হয়েছিল।
“গল্পটা ছিল, এমন একদিন আসবে যে আপনার জন্ম হলেই আপনাকে একটা ফোন নম্বর দেয়া হবে, এবং সেই ফোন না ধরলে আপনি মারা যাবেন। তাই আমরা জানতাম যে একদিন সবারই একটা করে ফোন থাকবে – কিন্তু সেই ফোনে যে একটা সুপারকম্পিউটার থাকবে, তাতে ডিজিটাল ক্যামেরা এবং ইন্টারনেট সংযোগ থাকবে – তা আমরা কল্পনাই করতে পারিনি। কারণ এগুলোর কোন কিছুই ১৯৭৩ সালে ছিল না।”
সেই ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসের তিন তারিখে – নিউ ইয়র্কের সিক্সথ এভিনিউ থেকে মার্টিন কুপার মোবাইল ফোনে প্রথম কলটি করেছিলেন।
ব্যাপারটা দেখতে তার সামনে উপস্থিত ছিলেন একজন সাংবাদিক।
“সে ছিল নিউইয়র্কের একটি রেডিও চ্যানেলের একজন রিপোর্টার। আমরা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। আমি আসলে আগে থেকে ভেবে রাখিনি যে কাকে ফোন করবো। আমি সাংবাদিকটিকে বললাম – এটিএন্ডটি কোম্পানিতে আমার পরিচিত একজন ইঞ্জিনিয়ার আছে, আমি তাকে ফোন করছি। তার নাম জোয়েল ইঙ্গল।”
এটিএন্ডটি তখন আমেরিকার এমন কি সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় টেলিকম কোম্পানির একটি। আর কুপারের মোটরোলা ছিল একটা ছোট কোম্পানি। তাদের মধ্যেই হলো মোবাইল ফোনের প্রথম কথোপকথন।
“আমি নাম্বারটি ডায়াল করলাম। কি আশ্চর্য ব্যাপার, জোয়েল নিজেই ফোন ধরলো। আমি বললাম, হাই জোয়েল, আমি মার্টিন কুপার বলছি। আমি তোমাকে ফোন করেছি একটা সেলফোন থেকে। একটা সত্যিকারের সেলফোন, একটি হাতে ধরা, ব্যক্তিগত ফোন – যা সাথে নিয়ে চলাফেরা করা যায়।”
“ওপাশ থেকে জোয়েল কোন কথা বললো না। একটা নিরবতা।”
“আমার মনে হলো সে হয়তো দাঁত কিড়মিড় করছে। তবে জোয়েল ছিল খুবই ভদ্র। আজও সে বলে, আমার সেই ফোন কলটির কথা তার মনে নেই। আমি অবশ্য তাকে এজন্য দোষ দিই না। আপনিই বলুন, প্রথম সেলফোন কলের অন্যপ্রান্তে থাকতে আপনার কেমন লাগার কথা।”
আসলে এটিএন্ডটিও তখন ভবিষ্যতের ফোন নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। সেলুলার টেকনোলজি নামে এক নতুন প্রযুক্তির সূচনা করেছিল তারাই। রেডিওর ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে একাধিক সেলের নেটওয়ার্কের মধ্যে বার্তাবিনিময় করার এ প্রযুক্তিই চলমান ফোন সম্ভব করেছিল।
কিন্তু এটিএন্ডটি চেয়েছিল এই নতুন প্রযুক্তিকে গাড়িতে ফোন সংযুক্ত করার জন্য ব্যবহার করতে। তারা ভেবেছিল গাড়ির সাথে সংযুক্তিই ফোনের ভবিষ্যৎ। হাতে করে ফোন নিয়ে ঘোরার কথা তারা ভাবে নি।
কিন্তু ছোট্ট কোম্পানি মোটরোলা এটিএন্ডটির সেই ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করলো।
“তারা মনে করতো, তারা তারের সংযোগওয়ালা ফোনকেই গাড়ির ভেতরে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছিল টেলিকম কোম্পানি আপনার গাড়ির মধ্যে ফোনকে আটকে ফেলছে – সেটার কোন মানেই হয় না।”
“মার্টিন এবং তার দল আরেকটা ব্যাপার জানতেন। সেটা হলো, আমেরিকার বেতার তরঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করে যে ফেডারেল টেলিকমিউনিকেশন কমিশন – তাদের কাছে এটিএন্ডটি দেনদরবার করছে যেন তাদেরকে রেডিও স্পেকট্রাম ব্যবহারের একচেটিয়া অনুমতি দেয়া হয়। কারণ এর ফলে তারা আমেরিকার যে লক্ষ লক্ষ গাড়ি সেলুলার প্রযুক্তি ব্যবহার করে – তাতে টেলিফোন সংযোগ দিতে পারবে।”
মোটরোলা জানতো যে যদি এটিএন্ডটি একবার এই একচেটিয়া কর্তৃত্ব পেয়ে যায়, তাহলে তারা তাদের হাতে-ধরা ফোনের জন্য সেই নেটওয়ার্ক আর ব্যবহার করতে পারবে না।
“এটিএন্ডটি তখন ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোম্পানি। ওয়াশিংটনে তাদের দু’জন লবিয়িস্ট ছিল। তাদের সাথে প্রত্যেক ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশনারের যোগাযোগ ছিল। আমাদের কর্মীর সংখ্যা ছিল তিন জন। ওদের ছিল দু’শো। ”
কাজেই এটা ছিল ডেভিড-গোলায়াথের লড়াইয়ের মতো। মোটরোলা জানতো – কমিউনিকেশন কমিশনারদের প্রভাবিত করতে হলে তাদের বড় মাপের কিছু একটা করতে হবে, ভবিষ্যতের ফোন কেমন হবে তা বোঝাতে হবে, এবং একটা মোবাইল ফোন তৈরি করে দেখাতে হবে।
এই ফোন তৈরির জন্য তাদের জাকে সময় ছিল তিন মাস। মোটরোলা কোম্পানি এ জন্য অনেক অর্থ বিনিয়োগ করেছিল।
“ফোনটা তৈরির জন্য ২০ জন লোক কাজ করছিল। কিন্তু মনে রাখবেন আমাদেরকে সেল ব্যবহার করে এমন রেডিও স্টেশনও বানাতে হয়েছিল। কাজেই সেটা তৈরির জন্য আরো ২০-৩০ জন লোক কাজ করছিল। নিউইয়র্কে ফোনটা কিভাবে কাজ করবে তা দেখানোর জন্য কাজ করছিল আরো কিছু লোক। যারা ফোনটা বানিয়েছিল তাদের দিনরাত কাজ করতে হয়েছিল।”
“তখন রেডিওর জন্য একটাই চ্যানেল বা স্টেশন ব্যবহৃত হতো। কিন্তু আমাদেরকে একটা হাতে ধরা ফোন সেটের মধ্যে শত শত স্টেশনকে ঢোকাতে হয়েছিল। আমরা এক হাজার মেগাহার্জের একটা সম্পূর্ণ নতুন রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করলাম। তা ছাড়া আরেকটা চ্যালেঞ্জ হলো, ফোনটা এমন হতে হবে যেন তাতে একই সময় কথা বলা ও শোনা যায়। তখন পর্যন্ত এমন প্রযুক্তিতে কথা বলার জন্য একটা বোতাম চাপতে হতো। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ছিল এমন একটা যন্ত্র তৈরি করা – যাতে একই সাথে কথা বলা ও শোনা যাবে, আবার তা এমন ছোট হতে হবে যেন তা হাতে ধরা যায়।”
শেষ পর্যন্ত মার্টিন কুপাররা যে ফোন তৈরি করলেন, তাতে ৩০টি সার্কিট বোর্ড ব্যবহৃত হয়েছিল। তার ওজন ছিল একটা বড় চিনির প্যাকেটের মতো। ১৯৭৩এর এপ্রিল মাসের সেই অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের দেখানোর জন্য দুটো প্রোটোটাইপ বানানো হয়েছিল। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে ১৫-২০জনের বেশি সাংবাদিক আসেন নি।
“আমরা সাংবাদিকদের মধ্যে খুব একটা আগ্রহ তৈরি করতে পারি নি। কিন্তু যখন আমরা মোবাইল ফোনটা কিভাবে কাজ করে তা দেখালাম – তখন কিন্তু সারা দুনিয়ায় এর খবর প্রচার হয়েছিল।”
“সেই অনুষ্ঠানে আসা রিপোর্টারদের একজন ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান। তিনি বললেন, আমি কি এটা দিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় আমার মাকে ফোন করতে পারি? আমরা বললাম, অবশ্যই। মনে মনে ভাবছিলাম, কি হবে কে জানে। তো সাংবাদিকটি তার মাকে ফোন করলেন, অস্ট্রেলিয়ায় তখন মাঝরাত, তাকে ঘুম থেকে জাগালেন। সেই মহিলা তো ফোন পেয়ে মহাখুশি।”
তবে আমেরিকার ফেডারেল নিয়ন্ত্রকদের কাছ থেকে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির গ্যারান্টি পেতে মোটরোলাকে আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এতে ভুমিকা রেখেছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগ্যানও।
শেষ পর্যন্ত ১৯৮৩ সালে প্রথমবারের মতো বাজারে এলো মোটরোলার প্রথম সেলুলার ফোন।
“বেশিরভাগ লোকই অবশ্য ভেবেছিলেন যে এই ফোন ব্যবহারের মতো আর্থিক সংগতি তাদের জীবনে কখনো হবে না। কারণ এর দাম ছিল চার হাজার ডলার, আর এই সেবার খরচও ছিল অত্যন্ত বেশি। বলতে পারেন, সেই প্রথম যুগের সেল ফোন ছিল বড়লোকদের একটা খেলনা।”
তবে তখনকার দিনে ওয়াল স্ট্রিটের মতো কিছু সিনেমাতে দেখা গিয়েছিল সেই সেল ফোন। আজকের মোবাইল ফোনের তুলনায় এগুলো ছিল বিরাট আকারের। অনেকটা জুতোর মত দেখতে বলে অনেকে এর নাম দিয়েছিলেন শু ফোন
“ঠিক তাই। আমরা একে বলতাম শু ফোন কিন্তু আমি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এর নাম দিয়েছিলাম ডাইনামিক এ্যাডাপটিভ টোটাল এরিয়া কাভারেজ – সংক্ষেপে ড্যাইনাট্যাক। আমার স্বপ্ন ছিল এমন একটা ফোন তৈরি করা যা দিয়ে আপনি যে কোন জায়গা থেকে আরেকজনের সাথে অবাধে কথা বলতে পারবেন। আমরা অবশ্য এর সবখানি অর্জন করতে পারি নি। তবে এখনকার ফোন তার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।”
কিন্তু মোবাইল ফোন যে মানুষের জীবনে এত বড় ঘটনা হয়ে উঠবে তা মার্টিন কুপার কখন প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন?
“সেটা বেশ কয়েকবছর পর – যখন প্রতিযোগিতামূলক দামে মোবাইল ফোন বাজারে পাওয়া যেতে শুরু করলো, মানুষ ফোনের দোকানের সামনে লাইন ধরতে লাগলো।”
“আর যখন আমরা জানতে পারলাম যে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে তারের সংযোগওয়ালা ফোনের চাইতে মোবাইল ফোনের সংখ্যা অনেক বেশি তখন আমরা বুঝলাম যে আমরা ঠিক কাজটাই করেছিলাম।”
মার্টিন কুপারের বয়স এখন ৯০এর কোঠায়। তিনি এখন বাস করেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। তিনি এখনো কাজ করছেন, এবং নানা জিনিস উদ্ভাবন করছেন।
এখন তার ভাবনা – কিভাবে এত ছোট ফোন তৈরি করা যায়, যা মানুষ কানে লাগিয়ে রাখতে পারবে এবং যা আপনার স্বাস্থ্য কেমন তার ওপরও নজর রাখতে পারবে।
সূত্রঃ বিবিসি বাংলা