অধিকাংশই জানেন না তাদের ডায়াবেটিস

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম বলেছেন, শুরুতে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। লক্ষণ না দেখা দিলে তো কেউ পরীক্ষাও করতে যাচ্ছেন না। আর এটা চট করে হয় না। ধীরে ধীরে হয়। এসব কারণে অনেকেই ব্যাপারটা খেয়াল করছেন না। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অন্তত ৫৪ শতাংশ জানেন না তারা আক্রান্ত।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুল জলিল আনসারী বলেন, তেমন কোনো উপসর্গ না থাকায় কেউ ডাক্তারের কাছে যায় না। সে কারণে প্রথমে রোগ ধরা পড়ে না। প্রথমদিকে জানতে পারলে খুবই ভালো হয়।

এ রোগ রোধে জনসচেতনার বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনসচেতনতা শুধু যে চিকিৎসকরা করতে পারবেন, তা নয়। মিডিয়া ও জনগণের সঙ্গে যারা জড়িত তারাও যদি জনগণকে পরীক্ষার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেন, তাহলে মানুষ আগ্রহের সাথে পরীক্ষা করবে। এর পরীক্ষা করা সহজ। অধিকাংশ কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিকে পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। অনেকে হয়তো জানেন না।

‘যার লক্ষণ নেই সে তো ডাক্তারের কাছে যাবে না কিংবা সে কেনো পরীক্ষা করবে’ উল্লেখ করে শাহাজাদা সেলিম বলেন, আমেরিকাতে ডায়াবেটিস আছে। আমাদেরও আছে। যাদের রিচফ্যাক্টর আছে, রিচফ্যাক্টরগুলো বলা আছে। ওই রিচফ্যাক্টর যখনই দেখা দেবে ডায়াবেটিস না থাকলেও তারা টেস্ট করবে। আর রিচফ্যাক্টর যদি নাও থাকে তাহলেও আমেরিকা তাদের জন্য নিয়ম করেছে, ৪৫ বছর বয়সে সবাইকেই পরীক্ষা করতে হবে। আমাদের দেশের জন্য আরও অনেক আগে হওয়া উচিত। আমাদের ধারণা ৩৭ বছরে হলে পারফেক্ট হয়। যার বাবা-মা, ভাই-বোন কারো ডায়াবেটিস নেই, নিজের কোনো লক্ষণ নেই তাও ৩৭ বছর বয়সে টেস্ট যদি ভালো আসে, আমেরিকাতে ওরা আবার ৫ বছর পর পর রিপিট করবে, আমাদের এখানে হয়তো ঘন ঘন করতে হবে। তবে আমাদের আসলে সেই গবেষণাও নেই। ২-৩ বছর পর পর করলে ভালো হয়। এটা আমাদের মতামত।’

যাদের পরিবারে ডায়াবেটিস আছে তাদের আরও আগে টেস্ট করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। বলেন, আরও কিছু কারণ আছে। যেমন ওজন বেশি, যার প্রেশার আছে, যার হার্টের একবার স্ট্রোক হয়েছে এসব যেকোনো ঘটনা ঘটলে তাকে অবশ্যই টেস্ট করাতে হবে।

অধ্যাপক ডা. আব্দুল জলিল আনসারী বলেন, মাতৃগর্ভ থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যেকোনো সময় ডায়াবেটিস হতে পারে। সচেতনার জন্য জনগণকে আমরা তিনভাগে ভাগ করতে পারি। যাদের বংশে ডায়াবেটিস নেই বা হয়নি, তাদের হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। তাদের ক্ষেত্রে ৪০ বছরের পর থেকে শুধু চেকাপ করাই যথেষ্ট। যাদের পরিবারে বা নিকট আত্মীয়ের আছে, তাদের পরিবারের সদস্য বা সন্তানের হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। তাই তাদের ২৫ বছরের পর থেকে ২ বছর বা ৫ বছর অন্তর পরীক্ষা করা দরকার। আর তৃতীয়ত, যাদের ডায়াবেটিস হয়ে গেছে, তাদের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ডায়াবেটিস প্রধানত দুই প্রকার। টাইপ-১ এবং টাইপ-২। টাইপ-১ এ আক্রান্তের সংখ্যা খুবই কম। ডায়াবেটিস আক্রান্তদের মধ্যে তা ৫ শতাংশ। টাইপ-১ সাধারণত ১০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে হয়ে থাকে। আর টাইপ-২ হয়ে থাকে ২৫ বছরের পর থেকে। যত বয়স বাড়তে থাকে তত আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। টাইপ-১ হলে ইনসুলিন ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে তার চিকিৎসা করা যায় না।

দেশে এই মুহূর্তে কতজন ডায়াবেটিসের রোগী আছে তার নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। বারডেম হাসপাতাল-২ এর শিশু ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞ কনসালটেন্ট ডা. বেদৌরা জাবিন এক উপস্থাপনায় বলেন, দেশে ২০ বছরের নিচে টাইপ-১ এ আক্রান্ত অন্তত ১৭ হাজার মানুষ।

শাহাজাদা সেলিম বলেন, ২০১৯ সালে ডিসেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন জানিয়েছিল দেশে প্রায় ৮৪ লাখ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত থাকতে পারে। আমাদের এখন ধারণা, এখনই এটা দেড় কোটির বেশি হতে পারে।

অধ্যাপক ডা. আব্দুল জলিল আনসারী বলেন, দেশে বর্তমানে প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ৮ ভাগই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে চার ভাগ ডায়াগনোসিস হয়েছে। বাকিদের ডায়াগনোসিস হয়নি, তবে তারা আক্রান্ত। তাতে সবমিলিয়ে দেশে ৮০ লাখ থেকে এক কোটির মতো মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আক্রান্তদের অর্ধেক নারী; অর্ধেক পুরুষ। তবে অপ্রকাশিত এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে এক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, এ গবেষণায় দেখা গেছে প্রাপ্ত বয়স্কদের ২৫ দশমিক ২ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ডায়াবেটিসের ক্ষতিকর প্রভাব মাথা থেকে পা পর্যন্ত সব অঙ্গ-প্রতঙ্গের ওপর পড়ে। বেশি আক্রান্ত হয় চোখ, দাঁত, হৃদযন্ত্র ও কিডনি। এছাড়া যৌন সমস্যা দেখা দেয়।

ডায়াবেটিস একসাথে দুই চোখকেই আক্রান্ত করে উল্লেখ করে আব্দুল জলিল আনসারী বলেন, রেটিনা আস্তে আস্তে নষ্ট হয়। ধীরে ধীরে তা অন্ধত্ব পর্যন্ত নিয়ে যায়। এছাড়া ছানি পড়ে, চোখে বেশি বেশি ইনফেকশন হয়। মুখের বেলায়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা না গেলে দাঁতের অসুখ বেশি হয়। দাঁত ক্ষয়ে যায়। দাঁতের গোড়ার চারদিকে ইনফেকশন হয়। ক্রমান্বয়ে একটার পর একটা দাঁত নষ্ট হতে থাকে। দাঁত ফেলে দিতে হয়। তাছাড়া মুখে অনেক ইনফেকশন হয়। ডায়াবেটিসে হার্ট সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। ডায়াবেটিসের কারণে কিডনিতে বড় ধরনের অসুখ হয়। এটাকে ন্যাবোপ্যাথি বলা হয়। ডায়াবেটিক রোগীদের দুটা কিডনিই একই সাথে আক্রান্ত হয়। ধীরে ধীরে একসময় কর্মক্ষমতা থাকেই না। চূড়ান্তভাবে কিডনি ফেইলার হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ডায়াবেটিস। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস পর্যায়ক্রমে শরীরের সমস্ত স্নায়ু সিস্টেমকে আক্রান্ত করে। প্রথমে ব্যথা, পরে অবশ, আস্তে আস্তে ঘা, শেষে পা কেটে ফেলতে হয়।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.